রাফিউজ্জামান রাফি
২২ জুন ২০২৩, ০৩:০৫ পিএম
কিছু মানুষ আছেন, যারা প্রচারের আলোয় আসতে চান না। অন্তরালে থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাদের মেধার শক্তি এতটাই যে, পর্দার আড়াল থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আলোকোজ্জ্বল করে তোলেন সবকিছু। তেমন একজন মানুষ সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরী। তার সুরে পাখিরা ডানা মেলে আকাশে। একাধারে তিনি যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। সম্প্রতি এই সুরের জাদুকর মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা মেইলের। সেই আলাপচারিতায় মনের আগল খুলেছেন তিনি। যখন কোনো গান করি তখন গানটাকে মনের মতো করে তোলাটাই লক্ষ্য থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করি সবকিছু ঢেলে গানটি সাজানোর। তবে গানটি মানুষের সমাদর পেলে ভালো লাগে। এর বাইরে কোনো লক্ষ্য থাকে না। ‘কথা কইয়ো না’র বেলায়ও এমনটা হয়েছে।

না, বিষয়টি সেরকম না। হাশিম ভাইয়ের ‘সাদা কালা’ জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এই গান করিনি। গানটি নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল। কারণ আমাদের খুবই প্রিয় গান এটি। কিন্তু তখন সিনেমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আর করা হয়নি। পরে কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে কথা হওয়ার পর গানটি তাদের শোনালে তারাও খুব পছন্দ করে। ওই জায়গা থেকেই ‘কথা কইও না’ গানটি করা।
আলেয়া বেগমকে হয়ত আমরা সেভাবে চিনি না। কিন্তু উনি হচ্ছেন বাউল মাতা। ওনার দারুণ একটা শক্তি আছে। তার বাবাও বাউল। স্বামী আবুল সরকার তো দেশের লিজেন্ডারি বাউল। আপামর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আলেয়া বেগম তুমুল জনপ্রিয়। এতটাই জনপ্রিয় যে তিনি সারারাত এক জায়গায় শো করে পরদিন সকালে কোক স্টুডিওর সেটে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ওনার জন্য এক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। তার শিডিউলই পাইনি। ওনার সঙ্গে আমার খুব আত্মিক সম্পর্ক। তিনি আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন। আমিও ওনার কণ্ঠের পাগল। ওনাকে প্রথম শুনি ফোক ফেস্টে। তখন থেকে ইচ্ছা ছিল তাকে দিয়ে একটা গান করাব। আলেয়া বেগমকে আমাদের সঙ্গে পেয়েছি এজন্য আমরা ভাগ্যবান।

আমাদের বাংলাদেশের সংগীত ভীষণ সমৃদ্ধ। হয়ত আমরা বিভিন্ন কারণে সেসব উপস্থাপন করতে পারি না। আমি প্রথম থেকেই চাচ্ছিলাম দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে যতটুকু পারি গানটি উপস্থাপন করার। আমাদের একটা রিসার্চ টিম আছে। যেহেতু আমরা সিনেমায় কাজ করি। সবাই ভাবছিলাম মাটিঘেষা কোন কোন বাদ্যযন্ত্র এখানে বাজানো যায়। আমি এর আগে কয়েক জায়গায় দেখেছি পাতার বাঁশি বাজাতে যেটা সচারচর দেখা যায় না। ওই জায়গা থেকে পাতার বাঁশির ব্যবহার। আর একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন পাতার বাঁশিটা সানাইয়ের মতো। ট্র্যাডিশনাল সানাই বলা যায়। হতে পারে পাতার বাঁশি থেকেই হয়ত বাঁশির উৎপত্তি হয়েছে।
এটা তো বলতে পারছি না। তবে আমার মনটা পাখির মতো। এ জন্যই হয়ত পাখি মনের সাথে পাখিরা মিলেমিশে আকাশে ডানা মেলতে ভালোবাসে।
প্রথমত দেশকে অনেক কিছু দিতে চাই। আমার কাছে সংগীত হচ্ছে নানা ফুলের মধুর মতো। আহরণ করতে মন চায়, গন্ধ নিতেও মন চায়, গন্ধ বিলাতেও মন চায়। সব ঘরানার সুরই আমার পছন্দ। সুরের সাধনা করে যেতে চাই।

তৃপ্ত হওয়া যাবে না। আর যদি প্রত্যাশার কথা আসে তবে বলব, আমার কখনও প্রত্যাশা ছিল না। আমি মনের আনন্দে মিউজিক করেছি। এখনও তাই করি। তারপরও যেহেতু সংসার আছে, চলতে হয়। কিন্তু এখনও আমি প্রফেশনাল সাইডটা আলাদা করে ফেলেছি। নিজের চলার জন্য বিজ্ঞাপনের কাজ করি। কিন্তু গানটা একেবারেই মনের আনন্দের জন্য করি, আত্মার খোরাক মেটাতে করি। আমার একটা স্বপ্ন আছে। যদি সৃষ্টিকর্তা সুযোগ দেন তবে আমাদের দেশীয় কোর মিউজিককে সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। মাটির সুর, মাটির গান সবার সামনে উপস্থাপন করতে চাই।
এটা যদি ওয়ার্ক করে তাহলে কিন্তু ভালো লাগে। যেমন আমরা ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম। এক গানের পর আরেক গান গাইতাম। এটা আমি মনে করি ওরকমই। আসলে ম্যাজিক তো হয় যখন গানটা ঘটে যায়। আমাদেরও ভালো লাগে। আর যেটা আসলে ভালো লাগে না লাগেই না। ওগুলো ঘটে নাই। গান ম্যাশাপ হতেই পারে। এটা নির্ভর করে সংগীতায়োজনের ওপর।

আমার যেটা মনে হয় গান সস্তা না দামি এটা বলার আগে একটা কথা বলা জরুরি। ধরুন, একটি গান ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু সেটা ওই লেভেলের গান না। আবার অনেক গান ওই লেভেলের হওয়া সত্ত্বেও চাপা পড়েছে। এটা নির্ভর করে মূলত শ্রোতাদের ওপর। তারা যখন যে মুডে থাকেন তখন সেই উপযোগী গান তাদের ভালো লাগে। এখন সেটা তথাকথিত সস্তা গানই হোক না ভালো গানই হোক। তারা মূলত নিজেদের মুডকেই প্রাধান্য দেন। আর একটা বিষয় হচ্ছে, ভালো গান কখনও চাপা পড়ে থাকে না। সেটা চিরকালই বেঁচে থাকে। আমাদের ‘সাদা কালা’ গানটার কথাই ধরুন। কী ছিল এতে? কিছুই না। আমার এই ঘরের ফ্লোরও গানটার পিচের একটা অংশ। এটা কিন্তু সবাই নিয়েছে। আর কিছু গান আছে যেগুলো হুট করে এসে হুট করেই চলে যায়। কিন্তু ভালো গান থেকে যায়। অনন্তকাল বেঁচে থাকে।
সিনেমার গান নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে। কাজ করছি ‘কাজল রেখা’ সিনেমায়। এই ছবির জন্য অনেকদিন অন্য কোনো কাজ হাতে নিইনি আমি। এই কাজটি নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী। আমার স্বপ্নের কাজ এটি। গিয়াসউদ্দিন সেলিম ভাইয়ের এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারাটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কেননা, এই ছবিতে বাংলার লোকজ সুর ও সংগীত নিয়ে কাজ করার বড় একটি জায়গা ছিল।
আমি প্রতিভায় বিশ্বাসী। আর প্রচারটা এই সময় জরুরি। তবে প্রচার করতে গিয়ে প্রতিভা নষ্ট করতে চাই না।
মিউজিশিয়ান, সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে খুঁজে পাই।
আরআর/আরএসও