সেলিম আহমেদ
০৫ অক্টোবর ২০২২, ১২:৩৬ পিএম
অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালকের (কলেজ ও প্রশাসন) দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি তিনি। শিক্ষক দিবসকে কেন্দ্র করে শিক্ষার নানা সংকট, সমাধানের উপায় ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন ঢাকা মেইলের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক সেলিম আহমেদ।
ঢাকা মেইল: বর্তমানে শিক্ষায় কি কি সংকট রয়েছে?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: শিক্ষার দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো-ব্যবস্থাগত দিক, অপরটি টিচিং, লার্নিং, প্যাডাগোজি, মেথোডোলজি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপিত হয়েছে অথচ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় যে পেশাদারিত্ব ও মৌলিকত্বের যে জায়গায় থাকার কথা সেটা বিল্ডাপ হয়নি। ফলে আমি যদি, আমার ক্যাডার সার্ভিসের কথা বলি এডুকেশনের জেনারেল ট্রিম ম্যানেজ করার দায়িত্ব কিন্তু এই সেক্টরের। কিন্তু আমরা দেখেছি এটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই কখনও তা নিয়ে সেইভাবে চিন্তা করা হয়নি। ক্যাডার সার্ভিসকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে খণ্ডিত করা হয়েছে। যেমন প্রাথমিককে আলাদা করা হয়েছে এখন সেকেন্ডারিকে আলাদা করার একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে। এডুকেশনকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে কতগুলো দ্বীপ তৈরি হয়েছে। আবার এদের মধ্যে কোনো কমিউনিকেশন নেই। কমিউনিকেশন হলেও তা পারফেক্ট না। সবগুলোইে ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এটি হলো একটি দিক। আবার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে একটি গ্যাপ আছে। উপজেলা থেকে শুরু করে হেড অফিস পর্যন্ত। ফলে টোটাল যে মনিটরিংয়ের কথা তা অনেক জায়গায় সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভব না হওয়ার কারণ হলো মন্ত্রণালয় বা পলিসি মেকাররা এভাবে কোনোদিন ভাবেননি। তারা তাদের মতো করে ভেবেছেন।
আরেকটা যদি বলেন, টিচিং লার্নিংয়ের জায়গাটা এখানে আসলে আকর্ষণীয় হতে হবে। শিক্ষকতায় মেধাবীদের আসতে হবে। মেধাবী শিক্ষক যদি তিনি যদি সত্যিকারের একজন মেধাবী ছাত্র হন। মেধাবী ছাত্র না হলে কখনও মেধাবী শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে, বর্তমান বাস্তবতায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় যারা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত আছেন, তারা নানা ধরনের ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হচ্ছেন। সোসাইটিতে নানা ধরনের পরির্বতন এসেছে, কিন্তু আমরা এটা দেখেছি যে অনেক ধরনের ডিসক্রিমিনেশন হচ্ছে। এই ডিসক্রিমিনেশনযেসব মেধাবীরা বাইর থেকে দেখছে, তারা এই পেশায় আসতে চাচ্ছেন না। আবার যারা ভেতরে আছেন, তাদের অনেকের কমিটমেন্টও আছে, কিন্তু নানাভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে এই জায়গায় যেহেতু ৫ তারিখ আমরা ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে আমরা পালন করছি সেই জায়গায় এসে শিক্ষাকে বিচ্ছিন্নভাবে ভাবলে চলবে না। শিক্ষা পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িত। এডুকেশন কিন্তু সব জায়গাকে প্রভাবিত করে। বর্তমান বাস্তবতায় এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ফিউচার এডুকেশন নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা চলছে। ব্ল্যান্ডার এডুকেশন নিয়ে কথা বলছি আমরা। টেকনোলজি ব্যবহার করাসহ ক্যারিকুলামে নানা পরির্বতন আসছে। এগুলো বাস্তবায়ন কিন্তু শিক্ষকরা ও তার ম্যানেজমেন্টে জড়িত যারা আছেন তারাই করবেন।
ঢাকা মেইল: প্রাথমিক শিক্ষাকে আলাদা করা কতটা যৌতিক?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: এটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। তখনকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা দখল করেছে প্রশাসন ক্যাডার বা অন্য ক্যডারের লোকজন। তাহলে তার মাথা থেকে তো শিক্ষা আসবে না। তাদের মাথা থেকে আসবে অন্য বিষয়। শিক্ষার বিষয় হলো উপলব্ধির বিষয়, ভেতরকার বিষয়। তারাতো বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এসে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কাজ করেন। আমরা কিন্তু পাঠ্যপুস্তক বছরের প্রথম দিন বিতরণ করছি। কারণ ম্যানেজমেন্টে এডুকেশনের লোক আছে বলে তা সম্ভব হচ্ছে। পরীক্ষার ফলপ্রকাশ হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেটাও সম্ভব হচ্ছে ব্যবস্থাপনায় এডুকেশনের লোকজন আছে বলে। সঠিক জায়গায় যদি সঠিক ব্যক্তিকে বসানো হয় তাহলে ব্যবস্থাপানায় কোনো অসঙ্গতি হবে না। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
ঢাকা মেইল: শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেই। এর কি প্রভাব পড়ছে?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: পেশাদারিত্বে জায়গায় যদি ওই পেশার লোক না থাকে তাহলে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে অনেকে বলে থাকেন এটাতো অ্যাডমিনিস্টেটিভ ইস্যু। কিন্তু না, এটাকে কোনোভাবেই আলাদা করা যাবে না। কারণ পলিসি ফরমোলেইট করার ক্ষেত্রে যিনি ওই বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনিই ভালো পলিসি ফরমোলেইট করতে পারবেন। এজন্য আমরা বলে থাকি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে কৃত্য পেশাভিত্তিক প্রশাসন দরকার। সেক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের পদায়ন করতে হবে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন। পেশাজীবিদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
ঢাকা মেইল: শিক্ষা ক্যাডাররা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: অন্য ক্যাডার সার্ভিসের মতো কাঠামো শিক্ষা ক্যাডারে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে জড়িত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এনিয়ে বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনাও বিগত ৪০ বছরে আমরা দেখিনি। তবে বর্তমান সরকারের আমলে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তাদের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ, জুনিয়র সিনিয়ররা একই স্কেলে কাজ করছেন- এছাড়াও নানা কারণে ক্যাডার সার্ভিসে একটি স্থবিরতা রয়েছে। মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চান না। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তও এখানে বাস্তবায়ন হয় না। সেইগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার সঙ্গে জড়ির ক্যাডারদের কর্মস্পৃহা বাড়বে।
ঢাকা মেইল: সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের ওপর হামলার কারণে শিক্ষকরা কী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: আসলে কিছু জায়গায়তো ঝুঁকি আছে। যেমন পাবলিক এক্সাম, শিক্ষার্থী ভর্তি ও ফর্ম পূরণের সময় শিক্ষকদের কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো যখন কোনো একজন অপরাধী যখন সাজা পায় না তখন কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বা সংশয় তৈরি হয়। কোনো অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর যদি অপরাধীদের সাজার মুখোমুখি করা হতো তাহলে তা কমে আসত।
ঢাকা মেইল: সারাদেশে বিভিন্ন কলেজকে সরকারিকরণ করা হচ্ছে? কিন্তু সেখানে শিক্ষক সংকট। এই সংকট নিরসনের কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: শিক্ষক সংকট নিরসনের জন্য পর্যাপ্ত পদ লাগবে। এই পদ সৃজনের একটি দায়িত্ব রয়েছে সরকারের। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা পদ সৃজনের প্রস্তাব দিয়েছি। সেটি ৪ থেকে ৫ বছর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঝুলছে। তাহলে প্রশ্নটি দাঁড়ায় আপনি আমাকে কোয়ালিটি ডেভেলপ করতে বলছেন, কিন্তু হাত পা বেঁধে দিয়েছেন। পর্যাপ্ত শিক্ষক যদি না থাকে তাহলে কীভাবে কোয়ালিটি এডুকেশন ইনশিউর করা সম্ভব।
ঢাকা মেইল: সারাদেশ থেকে মাউশিতে আসা শিক্ষকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। এই হয়রানি বন্ধের কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
শাহেদুল খবির চৌধুরী: যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই সেবা গ্রহীতাদের এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমি কখনও এটাকে অস্বীকার করি না। তবে আমরা সার্ভিস ডেলিভারিকে আমরা সিনলিফাই করার একটা চেষ্টা আমাদের রয়েছে। আবার সার্ভিস ডেলিভারিকে যদি আমরা পুরোপুরি টেকনোলজিবেইজড করতে পারি তাহলে তা থেকে উত্তোরণ সম্ভব।
এসএএস/এইউ