সেলিম আহমেদ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৬:১২ এএম
দেশের শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সমান সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট’। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ইউনিটটি দেশের রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখভাল, নানা জরিপ কাজ পরিচালনা ও শিশুদের স্কুলমুখী করতে অভিভাবকদের নিয়ে নানা জনসচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করত। কিন্তু ২০১৩ সালে দেশের সব রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ করা হলে বিলুপ্ত হয় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম।
বিগত সাড়ে ৯ বছর থেকেই কোনো কাজ নেই এই ইউনিটের। এক রকম অলস সময় পার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ তাদের বেতন-ভাতা, পরিবহন ও দাফতরিক ব্যয়, আপ্যায়ন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বছরে সরকারের চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় দফতরটি নিয়ে সাম্প্রতিককালে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক পক্ষ চাচ্ছে স্থায়ীভাবে দফতরটি বিলুপ্ত করতে। আরেক পক্ষ চায় নতুন করে ঢেলে সাজাতে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় দোটানায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে সকল রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি তারা উচ্চ আদালতে মামলা করেন। এ রকম ৮০ থেকে ৯০টি মামলা পরিচালনা আর সরকারি বিভিন্ন দিবস উদযাপন ছাড়া আর কোনো কাজ নেই দফতরটির। সারা বছরই হাজিরা দিয়ে এক প্রকার অলস সময় পার করেন কর্মকর্তারা। তবে মাঝে মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের প্রধান হলেন মহাপরিচালক। এছাড়া পরিচালকের তিনটি পদ, উপ-পরিচালকের সাতটি ও সহকারী পরিচালকের দুটিসহ মোট ৫৫টি পদে ৫২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দফতরটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকার যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এই ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই লক্ষ্য পুরোটাই অর্জিত হয়েছে। তাই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিটের আর প্রয়োজন নেই। ফলে দফতরটি ‘নিষ্কর্মা’ বলে পরিচিতি পেয়েছে।
তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে সংসদে পাস হয় ‘বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’। এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণের জন্য প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ওই বছরের ২১ আগস্ট ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৯২ সালের ৩১ নভেম্বর এর নামকরণ করা হয় ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট’। এ আইনের অধীনে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়।
এই ইউনিটের মূল কাজ ছিল বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও দেখভাল করা ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) প্রদান করা। এছাড়াও ৬ থেকে ১০ বছরের সব শিশুকে স্কুলমুখী করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যন্ত স্থানীয়দের নিয়ে করা হতো সচেতনতামূলক কমিটি। শিশু শিক্ষার অবস্থা জানতে দুই বছর পর পর করা হতো ‘চাইল্ড সার্ভে’ বা ‘শিশু জরিপ’।
সরকার যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এই ইউনিটটি প্রতিষ্ঠা করেছে সেই লক্ষ্য পুরোটাই অর্জিতও হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি এখন প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হারও কম। তাই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিটের আর প্রয়োজন নেই বলেও জানান সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। এই ইউনিটটি বিলুপ্ত করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে (ডিপিই) চাকরি ন্যস্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অবশ্য এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা চিন্তাভাবনাও শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক সূত্র। ইউনিটটি কীভাবে বিলুপ্ত করা যায় এ নিয়ে একাধিকবার বৈঠকও করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রাজধানীর আবদুল গণি রোডে ৬ তলা শিক্ষা ভবনের পঞ্চম তলায় ফ্লোরজুড়ে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের কার্যালয়। ভবনের বাকি পাঁচটি ফ্লোরেই রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের অফিস। জায়গার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে মাউশির দাফতরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য এই ইউনিটকে সরে যেতে একাধিকবার চিঠিও দিয়েছে মাউশি।
এই ইউনিটের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. কামাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সব প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হওয়ার কারণে স্কুলে ভবন নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ প্রায় সব কাজই ডিপিইর অধীনে চলে গেছে। আমাদের কাজ নেই বললেই চলে। তবে আমরা এখন বিভিন্ন কারণে জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া স্কুল ও শিক্ষকদের করা মামলাগুলো মোকাবিলা করছি।
ইউনিটটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবু বকর সিদ্দিক। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন কোনো কাজ নেই সত্য। সরকার কাজ দিলে কাজ হবে, বিলুপ্ত করতে চাইলে বিলুপ্ত করে দেবে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, এ দফতরের আপাতত তেমন কাজ নেই এ কথা সত্য। তাই দফতরটি নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। আশা করছি শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইউনিটটি বিলুপ্ত করা হবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। বলেন, আমাদের এ বিষয়ে একাধিক চিন্তাভাবনা রয়েছে।
এসএএস/এইউ