images

শিক্ষা

সমাবর্তন হয়নি ৩৯ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিপাকে শিক্ষার্থীরা

সেলিম আহমেদ

১৫ জুলাই ২০২২, ১০:১২ পিএম

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্তির পর সমাবর্তন ছাড়া তোলা যায় না মূল সার্টিফিকেট। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই বছরের পর বছর আয়োজন করা হয় না সমাবর্তন অনুষ্ঠানের। খোদ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসাবই বলছে, দেশের অনুমোদিত ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। এতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পরও অনেকেই মূল সার্টিফিকেট হাতে না পাওয়ায় কর্মক্ষেত্র ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে নানা বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প পরিসরে হলেও প্রতি বছর সমাবর্তন করা উচিত। আর ইউজিসি বলছে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও সমাবর্তন হয়নি তাদের দ্রুত সমাবর্তনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সমাবর্তন হয়নি এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-রাজধানী ঢাকার ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি।

রাজধানী ঢাকার বাইরের বগুড়ার পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মুন্সীগঞ্জের হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সিলেটের নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, কিশোরগঞ্জের ঈশাখাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ, শরীয়তপুরের জেড. এইচ. সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ, খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, ফেনীর ফেনী ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফরিদুপরের টাইমস্ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ, রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নাটোরের রাজশাহী সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজারের কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নারায়ণগঞ্জের রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরের জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বরিশালের গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, কুমিল্লার সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দপুরের বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ- টেকনোলজি, নাটোরের বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লার বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মানিকগঞ্জের এন. পি. আই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, বরিশালের ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।

এর মধ্যে রাজধানীর তুরাগের বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাবর্তনের জন্য আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এখনও সব বিশ্ববিদ্যায়কে বলিনি যে, এত বছর পরপর সমাবর্তন করতে হবে। আর সমাবর্তনের জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তবে প্রতি বছরই সমাবর্তন হওয়া উচিত।’

চেয়ারম্যান বলেন, সমাবর্তন না করলে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সমাবর্তন না করে মূল সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না। আর সমাবর্তন না করে ‘প্রবেশনারি’ সার্টিফিকেট দেওয়া হলে তা অনেক জায়গায় রিকোমেন্ট করতে চায় না। বিদেশেও অনেক প্রতিষ্ঠান এলাউ করে না। তাই আমি আবারও বলব, স্বল্প পরিসরেও হলে যেন সব বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল মান্নান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাবর্তন ছাড়া মূল সার্টিফিকেট দেওয়ার রেওয়াজ নেই। তবে সমাবর্তনের আগে ‘প্রবেশনারি’ সার্টিফিকেট দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেখানে ভিসির সই ছাড়া পরীক্ষা কন্ট্রোলার ও রেজিস্টার সই করে এই সার্টিফিকেট দিতে পারেন। কিন্তু মূল সার্টিফিকেট ছাড়া শিক্ষার্থীরা বিদেশে ভালো প্রতিষ্ঠানে আরও উচ্চ শিক্ষা নিতে পারে না। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই   ‘প্রবেশনারি’ এলাউ করে না। এতে শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সমাবর্তন না করলে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সমাবর্তন করাতে বাধ্য করতে পারে।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমাবর্তন করলে গেলে কিছু রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করতে হয়। এগুলো করে না বলেই তারা সমাবর্তন করতে পারে না। আমার জানামতে, দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনের কথা চিন্তাও করে না।’   

প্রবীণ ইতিহাস ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অপরিহার্য। সমাবর্তন হবে না কেন? যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে তাই তারা এ দিকে নজর দেয় না। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন হলেও সমাবর্তনের যে নিয়মনীতি আছে সেগুলো অনুসরণ করা হয় না।’

এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষা সংকটের সমান্তরাল সমাধান, এর জন্য দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু না হলে প্রত্যেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যকরণের সুযোগ আইনেই আছে। মোটকথা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় কী না সে ব্যাপারে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা আছে বলে আমার মনে হয় না।’

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘২০১০ সালে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন করা হয়েছে এখানে উপাচার্য কিংবা অন্যান্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের কোনো যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি। এখন কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের সব যোগ্যতা নির্ধারণ করা থাকলেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে না কেন? আমার মত হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ নির্বাহী পদগুলো নিয়োগ দেওয়া হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে, ঠিক তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গঠন করা দরকার।’

নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা আশা করে তাকে তাদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু বছরের পর বছর অপেক্ষার পরও সমাবর্তন হয় না। কেন সমাবর্তন হয় না তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আর শিক্ষকরা দিনদিন মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছেন। তারা তাদের কতর্ব্যটুকু বোঝে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বউদ্যোগী হয়ে সমাবর্তন আয়োজন না করে উপরের হুকুমে দিকে চেয়ে থাকেন। শুধু হুকুম আসলে তা পালন করেন।’

এই শিক্ষবিদ বলেন, ‘বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎয়ের কথা চিন্তা না করে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। বছরে কত লাভ হলো সেই হিসাব কষতে থাকেন। সমাবর্তন করতে হলে যদি টাকা খরচ হয় সেজন্য তারা সমাবর্তন করে না।’

রাশেদা বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎসংখ্যক শিক্ষকরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করে একটি দলের ক্যাডারের দায়িত্ব পালন করেন। সব শিক্ষক যদি শুধু শিক্ষা নিয়ে কাজ করতেন তাহলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই অবস্থা হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন একচুয়েলি লেখাপড়া হয় না। সমাবর্তনের পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় জোর দেওয়া জরুরি।’

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও সমাবর্তন হয়নি তাদের দ্রুত সমাবর্তন আয়োজনের জন্য চলতি মাসেই চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই সমাবর্তন আয়োজনের জন্য আবেদন করেছে, আবার অনেকে নানা অজুহাত দেখিয়েছে সমাবর্তন আয়োজন করতে না পারার। তবে সব প্রতিষ্ঠানকেই বাধ্যতামূলকভাবে সমাবর্তন আয়োজন করতে হবে।’

এসএএস/জেবি