images

শিক্ষা

শিবির-দুর্গ ভেঙে রাকসুর জিএস আম্মার!

আব্দুল হাকিম

১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫২ পিএম

  • শিবির প্রার্থীকে দ্বিগুণ ভোটে হারালেন
  • সাধারণ শিক্ষার্থীর ভরসায় বড় জয়
  • আম্মার পাল্টে দিলেন চেনা হিসাব
  • ‘স্লোগান মাস্টার’ এখন রাকসুর জিএস
  • চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে নামেন আম্মার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ভূমিধস বিজয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তবে এই ক্যাম্পাসে শিবিরের জন্য বড় ধাক্কা হলো জিএস পদটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। এই পদে বিজয়ী হয়েছেন অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন আম্মার। শিবিরের দুর্গ ভেঙে তার এই বিজয়কে দীর্ঘদিনের রাজনীতির চিত্র পাল্টে যাওয়ার সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনের মঞ্চে ‘স্লোগান মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত আম্মার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভরসায় শিবির প্রার্থীকে প্রায় দ্বিগুণ ভোটে পরাজিত করেছেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, আম্মারের জয় মানে ছাত্রদের জয়। নতুন ভাবনার রাজনীতি ও প্রথাগত শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতীকী উত্থান সালাউদ্দিন আম্মার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস সংস্কার দাবির মঞ্চ—সবখানেই সক্রিয় থাকা আম্মারের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা এবার ভোটে রূপ নিয়েছে। তবে এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে শিক্ষার্থীর স্বার্থে কাজ করা।

শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সকালে ফল ঘোষণার পরপরই ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে, এমনকি হলগুলোতেও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। অনেকেই একে অবিশ্বাস্য কিন্তু যৌক্তিক জয় বলেই অভিহিত করেছেন। আম্মারের পক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীর এমন সমর্থন আগে খুব একটা দেখা যায়নি। রাবিতে ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় ও সংগঠিত বলেই পরিচিত ছিল। সেই শক্ত ঘাঁটিতেই এবার জয়ী হয়েছেন আম্মার।

আন্দোলনের মাঠ থেকে ভোটের মাঠে

সালাউদ্দিন আম্মারের রাজনৈতিক যাত্রা খুব বেশি পুরনো নয়। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১–২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই তার নাম প্রথম আলোচনায় আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে, শহীদ মিনারের সামনে কিংবা প্রশাসন ভবনের পেছনে যেখানেই কোনো প্রতিবাদ, সেখানে সবার আগে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে দেখা যেত আম্মারকে। সে সময় থেকেই সহপাঠীরা তাকে ‘স্লোগান মাস্টার’ নামে ডাকতে শুরু করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারিন জাহান বলেন, ‘আম্মার ভাইকে আমি প্রথম দেখি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন ওর কথায় একটা দৃঢ়তা ছিল। সে সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল—ছেলেটা একদিন বড় কিছু করবে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক। আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রশাসনিক ভবনের সামনে তার নেতৃত্বে একাধিক মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। সে সময় আম্মারের প্রচারিত স্লোগান, যেমন—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো রাবির মাটি, কিংবা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা—এসব দ্রুতই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

Ammar2
বিজয়ী হওয়ার পর ভিপি ও এজিএসের সঙ্গে জিএম আম্মার। ছবি: সংগৃহীত

তবে ছাত্ররাজনীতিতে তার আগমন আকস্মিক নয়। অনেকের মতে, আন্দোলনের আগেই তিনি ছিলেন ক্যাম্পাসে সক্রিয় ও সচেতন শিক্ষার্থী। ফিল্ম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়েও কর্মসূচি দিয়েছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে নামেন তিনি। এই পরিসরে গড়ে ওঠে তার নেতৃত্বের বীজ।

ভোটের ময়দানে বড় ব্যবধান

রাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে সালাউদ্দিন আম্মার পেয়েছেন ১১ হাজার ৪৯৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, শিবির সমর্থিত প্যানেলের ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৭ ভোট। এই ফলাফলে প্রায় দ্বিগুণ ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এমন ব্যবধান রাবির সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুবই বিরল।

ফল ঘোষণার পর হলগুলোতে আম্মারের সমর্থক শিক্ষার্থীরা আনন্দ মিছিল করেন। কেউ কেউ কণ্ঠে বলছিলেন—আম্মার মানে অন্যরকম রাজনীতি। আরেক দল শিক্ষার্থী বলছিলেন, আম্মার জয় মানে ছাত্রদের জয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন বলেন, রাবিতে এত দিন ছাত্ররাজনীতি ছিল ভাগ করা। কেউ এক দলের, কেউ আরেক দলের। কিন্তু আম্মার ভাই সেই বিভাজনটা ভেঙে একটা জায়গায় সবাইকে একত্র করেছেন। আন্দোলন থেকে যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন, সেটাই এখন ভোটে রূপ নিয়েছে।

আম্মার কেন এত ভোট পেলেন?

এই প্রশ্নটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রে—কেন এবং কীভাবে শিবিরের মতো সংগঠিত প্রভাবশালী একটি শক্তির প্রার্থীকে হারিয়ে সালাউদ্দিন আম্মার এত ভোট পেলেন?

শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। প্রথমত, আম্মারের দীর্ঘ আন্দোলন ও মাঠের সংস্পর্শ। গত এক বছরে তিনি যেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশে থেকেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেভাবে অন্য কোনো প্রার্থীকে দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, তার প্রচারণা ছিল অত্যন্ত মানবিক ও সরল। তিনি কখনো দলীয় প্রতীক বা বড় রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করেননি। বরং বলেছিলেন—এই নির্বাচনে জিতলে আমি থাকব শিক্ষার্থীর পক্ষে, প্রশাসনের নয়। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার উপস্থিতি ছিল স্বচ্ছ ও প্রভাবশালী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া নূর বলেন, ‘আম্মার ভাইয়ের ফেসবুক লাইভগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সে অন্যরকম একজন মানুষ। রাজনীতি তার কাছে ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব।’

Ammar3
ফলাফল ঘোষণার সময় মায়ের পাশে আম্মার। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে কিছু শিক্ষার্থী মনে করেন, ছাত্রশিবিরের দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক আধিপত্য একঘেয়েমি তৈরি করেছিল। একই মুখ, একই ধরনের রাজনীতি শিক্ষার্থীদের ক্লান্ত করে তুলেছিল। সেই শূন্যতায় একজন নতুন, বিকল্প মুখ হিসেবে আম্মারকে তারা গ্রহণ করেছে।

‘স্লোগান মাস্টার’ এখন রাকসুর জিএস

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সালাউদ্দিন আম্মার নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিনেমা, নাটক, আবৃত্তি—সব জায়গায় তার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এমনকি আন্দোলনের দিনগুলোতেও তিনি গান ও কবিতা দিয়ে সহপাঠীদের অনুপ্রাণিত করেছেন।

একসময় স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করতেন তিনি। কিন্তু আন্দোলনের সময় সেই চাকরি ছেড়ে দেন। তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেন, ওর জীবনে টাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অবস্থান—সে চায় নিজের অবস্থানটা স্পষ্ট হোক। আম্মারের এই ত্যাগ ও সরল জীবনধারাই তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীর কাছে কাছের মানুষে পরিণত করেছে।

পরিবর্তনের ইঙ্গিত

রাকসু নির্বাচন দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত হলো। অনেকের মতে, এই নির্বাচনের ফল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করেছে। শিবিরের শক্ত ঘাঁটি ভাঙা শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তনেরও প্রতিফলন।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহতাব হোসেন বলেন, ‘এটা এমন এক নির্বাচন যেখানে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে কেউ প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমরা নিজেরা ভেবে ভোট দিয়েছি। যে ছেলেটাকে প্রতিদিন টুকিটাকিতে দেখতাম, তার জন্য ভোট দিয়েছি।’

সাদিয়া আফরিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আম্মার ভাইকে আমি চিনতাম রাবি সংস্কার আন্দোলনের সময়। তখন মনে হয়েছিল, এই ছেলেটার মধ্যে কিছু আছে। আজ সে জিতেছে, মনে হচ্ছে আমরাও জিতেছি।’

প্রশাসন ও ভবিষ্যতের দায়িত্ব

বিজয়ের পর সালাউদ্দিন আম্মারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন দায়িত্ব পালন। নির্বাচনে জয় মানে শুধু পদ নয়; শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার ভারও বহন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটিও এখন দেখার বিষয়। কারণ অতীতে আন্দোলনের সময় তিনি প্রশাসনিক নানা সিদ্ধান্তের সমালোচক ছিলেন।

Ammar4
‘আন্দোলনের স্লোগান মাস্টার’ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত আম্মার। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করেন, আম্মার তার নেতৃত্বের সময় রাবির ছাত্রসমাজকে আরও একত্র করতে পারবেন। তার প্রস্তাবিত ‘খোলা দরবার’ বা ‘শিক্ষার্থী প্রতিনিধি পরিষদ’ গঠনের পরিকল্পনাকে তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম বলেন, ‘ওর নেতৃত্বে আমরা আশাবাদী। সে যদি তার অবস্থান ঠিক রাখে, তাহলে রাবির রাজনীতি বদলে যাবে।’

বিজয়ী হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আম্মার বলেছেন, ‘আমার ম্যান্ডেট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেটের বাইরে আমি একমুহূর্ত থাকব না, ইনশাআল্লাহ। আমি শিক্ষার্থীদের নিয়েই থাকতে চাই, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব আমি ইনশা আল্লাহ পালন করব।’

সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরও বলেন, ‘আজ থেকে এক বছর পরে দায়িত্ব পালন শেষে আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে কেমন লাগছে। যদি দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে পারি, তাহলে হয়তো এভাবে সম্মানের সঙ্গে আপনাদের কাছে এসে বলতে পারব যে আমি এই এই দায়িত্ব পালন করেছিলাম। আর যদি দায়িত্ব পালন না করতে পারি...! আল্লাহ এটা না করুক। যে সম্মান নিয়ে আজকে ঢুকছি, সেই সম্মানটা নিয়ে বের হতে চাই।’

এএইচ/জেবি