আব্দুল হাকিম
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম
• মোট প্রার্থী ২৪৭ জন
• ভোটার সংখ্যা ২৮,৯০১
• নারী ১১,৩০৫, পুরুষ ১৭,৫৯৬ ভোটার
• ৯৯০ বুথে ভোটগ্রহণ
• এক শিক্ষার্থী দেবেন ৪৩টি ভোট
রাত পোহালেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। ৩৫ বছর পর এ ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি হতে চলেছেন শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ বিরতির পর এই ভোটে ক্যাম্পাসে নতুন রাজনৈতিক উদ্দীপনা বিরাজ করছে। এবারের নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদ—সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহ–সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)—পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্ণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ছাত্রদলের একক আধিপত্য থাকলেও এবার ভোটের মাঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করছে। কোনো একক প্রার্থী বা প্যানেলকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে রাখার সুযোগ নেই।
শিক্ষার্থীরা ভোটের জন্য প্রস্তুত, আর প্রচারণা শেষ হওয়ায় ভোটকে ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে। আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে অন্তত ১১টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে; এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও মাঠে নেমেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে তীব্র আলোচনা—কে হবে নতুন নেতৃত্ব, কোন প্যানেল বা প্রার্থী কতটা এগোবে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নয়টি ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলবে। ভোটগ্রহণ শেষে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
ভিপি পদ
ভিপি পদে মূল লড়াই হতে পারে ছাত্রশিবির–সমর্থিত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ও ছাত্রদল–সমর্থিত শেখ নূর উদ্দীন আবীরের মধ্যে। এই দুজনই শক্তিশালী প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। বাম–সমর্থিত ফুয়াদ রাতুল এবং ছাত্র অধিকার প্যানেলের মেহেদী মারুফও আলোচনায় রয়েছেন। প্রার্থী ও প্যানেলের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থার কারণে ভিপি পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই নিশ্চিত মনে হচ্ছে।
জিএস পদ
জিএস পদে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। শিবির–সমর্থিত ফাহিম রেজা, সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দীন আম্মার এবং ছাত্রদলের নাফিউল ইসলাম জীবন—এই তিনজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিটি প্রার্থীই নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাই এই পদে কে জয়ী হবেন তা এখনো অনিশ্চিত।
এজিএস পদ
এজিএস পদেও উত্তাপ কম নয়। ছাত্রদলের জাহীন বিশ্বাস এষা ও শিবিরের সালমান সাব্বিরের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থাকায় শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে আগ্রহী এবং ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন দেখা যেতে পারে।
ক্যাম্পাসজুড়ে প্রস্তুতি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রাকসু নির্বাচনে মোট ২৩টি পদের জন্য লড়ছেন ২৪৭ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ১৮ জন, জিএস পদে ১৩ জন এবং এজিএস পদে ১৬ জন প্রার্থী রয়েছেন। মোট ১১টি প্যানেল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ৫টি পদে ৫৮ জন এবং ১৭টি হলে হল সংসদ নির্বাচনের ১৫টি পদের বিপরীতে মোট ৫৯৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ভোটার তথ্য
এবার রাকসু ও সিনেট নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৮,৯০১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১১,৩০৫ জন এবং পুরুষ ভোটার ১৭,৫৯৬ জন। একজন শিক্ষার্থী মোট ৪৩টি ভোট দেবেন—রাকসুতে ২৩টি, সিনেটে ৫টি এবং হল সংসদে ১৫টি। ভোটের সময় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করে ১৭টি কেন্দ্রে মোট ৯৯০টি বুথ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একটি করে বুথ এবং ৬ রঙের ব্যালট বাক্স রাখা হবে। প্রতিটি ব্যালট বাক্সে থাকবে স্ক্যানিং মেশিন এবং ভোটগ্রহণ চলাকালে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হবে।
ভোটকেন্দ্র ও বুথ নির্মাণ
সরেজমিনে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচনী বুথগুলো প্রস্তুত। সাদা কাপড় ও কাঠ–বাঁশ ব্যবহার করে প্রতিটি বুথ তৈরি করা হয়েছে। বুথের ভেতরে একটি করে টেবিল রাখা হয়েছে। শহীদ হোসেন সিরাজী একাডেমিক ভবন, জুবেরী ভবন, রবীন্দ্র ভবনসহ অন্যান্য একাডেমিক ভবনে বুথ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন বা শেষ পর্যায়ে। ভোটের নিরাপত্তা জোরদারে প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
নির্বাচনী পরিবেশ
নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাস সরগরম হয়ে উঠেছে। পোস্টার, ব্যানার ও প্রচারণামূলক কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। শিবির–সমর্থিত প্যানেল, ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন। মেয়েদের হলেও প্রার্থীরা উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শোনার চেষ্টা করছেন।
শিক্ষার্থী নাসিমুল মুহিত ইফাত বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন হচ্ছে। রাজনৈতিক প্যানেলগুলোর মধ্যে শিবির ও ছাত্রদল–সমর্থিত প্রার্থীরাই এগিয়ে আছেন। তাদের রিজার্ভ ভোট শক্তিশালী।
ছাত্রী ফারিহা ইসলাম মিম বলেন, ভোট আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। যদিও মূল আলোচনায় ছাত্রদল ও শিবির, তবুও স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গণযোগাযোগ বিভাগের পাপিয়া আক্তার বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নতুনত্ব আছে। তারা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিয়াম বলেন, ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল এবারের নির্বাচনে গোছানোভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। বিশেষ করে ভিপি ও এজিএস পদে তাদের অবস্থান শক্ত।
নির্বাচনী নির্দেশনা ও সময়সূচি
নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভোট সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে। সকাল সাড়ে ৮টায় সব কেন্দ্রে গণমাধ্যম ও প্রার্থীর উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স সিল করে তালাবদ্ধ করা হবে। বিকেল ৪টার পরে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। ভোট গণনা শেষে একই দিন ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
নির্বাচন কমিশন আশা করছে, ভোটের দিন শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেবেন। বুথ এবং কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি থাকায় নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে তাদের পছন্দমতো ভোট দেবেন।
শিবির ও ছাত্রদল–সমর্থিত প্রার্থীদের প্রধান লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই কারণে এবারের রাকসু নির্বাচন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ও অপ্রত্যাশিত হতে পারে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ. নজরুল ইসলাম বলেছেন, নিরাপদ ক্যাম্পাস, অংশগ্রহণমূলক ভোট এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। নির্বাচিত প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ রাখতে শিক্ষার্থী, প্রার্থী ও সংবাদমাধ্যমের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। আমরা প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এটি কেবল একটি ভোট নয়, বরং শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশ এবং দায়িত্ববোধ গঠনের এক অসাধারণ সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। আমরা আশা করি, সংবাদকর্মীরা ইতিবাচক ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন।
এএইচ/এআর