মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪১ এএম
রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি সরকারি কলেজ দীর্ঘদিন ধরেই বেশ আলোচনায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলো কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করা হয়। সেখানে নানা সংকট দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় এসব কলেজের সমন্বয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ করা হবে। নতুন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে বেশ খানিকটা এগিয়েছে।
তবে সাত কলেজ নিয়ে সংকট আর অস্থিরতা যেন কিছুতেই কাটছে না। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা সংকট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান খসড়া অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হলেই স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্য হারাবে সাতটি কলেজ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজের তুলনায় আসন সংখ্যা অর্ধেক কমে যাবে, যা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পথ সংকুচিত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর, প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে গত রোববার (১২ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা কলেজের ঐতিহ্য রক্ষার দাবি জানানো হয়।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ এগিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অনেক শিক্ষক শুরুতে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে তারা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সরে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের দাবি, যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এতে কলেজগুলো স্বতন্ত্র ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। পাশাপাশি তৈরি হবে নানা সংকট। এছাড়া বিসিএস ক্যাডারের পদও বিলুপ্ত হতে পারে বলে শঙ্কা করেছেন তারা।
সাতটি কলেজের মধ্যে পাঁচটিতে স্নাতক ও স্নাতকত্তোরের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। ফলে এসব কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা জানান, এভাবে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে অনেকের জন্য সমস্যা হবে। যার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ঢাকার অন্য বেসরকারি কলেজে চাপ বাড়বে এবং অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আগে থেকে আন্দোলন করে আসছেন কলেজগুলোর স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী।
আসন সংখ্যা কমায়, উচ্চ শিক্ষা সংকটের শঙ্কা
সাত কলেজের স্নাতক পর্যায়ে আসন সংখ্যা ২৬ হাজারের বেশি। আর উচ্চ মাধ্যমিকে আসন সংখ্যাও ১০ হাজারের বেশি। তবে প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর অসন সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এটা দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় সংকট হয়ে দাঁড়াবে বলে জানান অনেকে।
আরও পড়ুন: সংকট পিছু ছাড়ছে না ৭ কলেজের!
ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের আসনগুলো শুধু ছাত্রীদের এবং ঢাকা কলেজের আসনগুলো শুধু ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। এছাড়া সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং সরকারি বাঙলা কলেজে ছাত্রছাত্রী উভয়ই ভর্তি হতে পারবে। সরকারি এই সাত কলেজের মধ্যে পাঁচটিতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে ইডেন ও তিতুমীর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুর ইসলাম বলেন, শিক্ষাকে বাণিজ্য ব্যবসায় রূপান্তরের জন্য এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো দেওয়া হয়েছে। আমরা এমন চাই না। কলেজগুলোর স্বতন্ত্র মডেলের বিশ্ববিদ্যালয় চাই। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের কথা না শুনে এমন কাঠামো দেওয়া হয়েছে।
সংকটের শুরু যেভাবে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বাদ দিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। বরং তৈরি হয় নানা জটিলতা। অধিভুক্তির পর ঠিক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া, ফল প্রকাশ, হয়রানি বন্ধ, পড়াশোনার খরচ বেশিসহ বিভিন্ন দাবিতে নানা সময়ে আন্দোলন করে আসছেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি বাতিল করে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অধ্যাদেশ খসড়া হলেও সংকট কাটেনি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শিরোনামে এই খসড়া প্রকাশ করা হয়। এছাড়া যেকোনো অভিযোগ ও পরামর্শের জন্য মতামতও চাওয়া হয়েছে। যা গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে চারটি প্রধান স্কুল বা অনুষদ। সায়েন্স, আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, বিজনেস স্টাডিজ এবং ল অ্যান্ড জাস্টিস। শিক্ষা কার্যক্রম হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। ৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে ও ৬০ শতাংশ অফলাইনে। তবে সব পরীক্ষা সশরীরে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। স্নাতক পর্যায়ের ২৩টি বিষয়ের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। একেকটি কলেজে একেকটি অনুষদ বা একাধিক বিভাগ থাকবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন, সংকটের তীব্রতা
রাজধানীর সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা এখন মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। সোমবার (১৩ অক্টোবর) শিক্ষা ভবন এলাকায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাদেশ দ্রুত জারির দাবিতে শিক্ষা ভবন অভিমুখে সোমবার (১৩ অক্টোবর) পদযাত্রা করেন। আরেক দল দাবি করছে—পদযাত্রার নামে মব সৃষ্টি করে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে এবং এজন্য তারা শহীদ মিনারে শান্তির মিছিল ও ঐক্য সমাবেশ করবে। এছাড়া গত ১২ অক্টোবর ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব মোড় দখল করে বিক্ষোভ করেন।
যেভাবে চলবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়
প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুধু দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে। প্রথম চার সেমিস্টার সাধারণ বিষয়, পরের চারটি ডিসিপ্লিনভিত্তিক। চারটি সেমিস্টার শেষ করার পর শর্ত পূরণসাপেক্ষে শুধু নিজ ক্যাম্পাসে ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে সকালে চলবে উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস।
এই সাতটি কলেজের অবকাঠামো ও ক্যাম্পাস স্থায়ীভাবে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত) ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। যেসব কলেজে এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তর আছে, সেগুলো অক্ষুণ্ন থাকবে। এছাড়া সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য নিয়োগ হবে। প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ও ইমেরিটাস অধ্যাপকের পদসহ গবেষক ও কর্মচারীর যেকোনো পদ সৃষ্টি করা যাবে। তবে বিদ্যমান শিক্ষকদের বিষয়ে অধ্যাদেশে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।
শিক্ষকদের বিরোধিতার কারণ
প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির বিরুদ্ধে সাতটি কলেজের শিক্ষকরা একযোগে মানববন্ধন করেছেন। এছাড়া শিক্ষকরা ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন। সেগুলো হলো- কলেজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কলেজের নামে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে; তা বিশ্ববিদ্যালয় নামে হস্তান্তর করা যাবে না; বিদ্যালয়ের (কলেজগুলোর) কার্যক্রম, পাঠদান ও অবকাঠামোর গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অবশ্যই পৃথক স্থানে হতে হবে, অর্থাৎ সেটা কলেজ ক্যাম্পাসে ভাড়া ভিত্তিতে চালানো যাবে না; প্রস্তাবিত ‘পরীক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয় মডেল’ (যা কলেজগুলোর সব বিষয় একসময়ে চলবে না) চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ ১৮৫ বছরের ঐতিহ্যের ধারক। শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস, ভূমিকা ও প্রভাব পর্যালোচনায় এটি একটি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বা বিশ্ব ঐতিহ্য। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সবাই আমরা এই মহীরুহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কার্যকর ভূমিকা ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক ও বর্তমান ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা অসংখ্য সভা করে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো তৈরি করেছি। এখানে কোনো কিছু লুকানো নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ ও পরামর্শ দিতে সবার কাছে আহ্বানও করা হয়েছে।’
মন্ত্রণালয় যা বলছে
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। যেখানে ছয় হাজারেরও অধিক মতামত পাওয়া গেছে। বর্তমানে মতামতগুলো সংকলন ও বিশ্লেষণের কাজ চলমান রয়েছে। ওই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ অংশীজনের সঙ্গে শিগগিরই ধারাবাহিক পরামর্শ সভা আয়োজন করা হবে। অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সবার মতামতের প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
এএসএল/জেবি