মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৪০ এএম
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে পালিত হয় দিবসটি। শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার এ দিনে বিভিন্ন দেশে নানা আয়োজনে শিক্ষককে সম্মান জানানো হলেও, বাংলাদেশে বেশিরভাগ শিক্ষক মনে করছেন-তাদের পেশার মর্যাদা ও আর্থিক প্রাপ্তি এখনো প্রাপ্য মানে পৌঁছায়নি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নানা পর্যায়ের শিক্ষকরা বলছেন, দায়িত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু সম্মান ও সুবিধা সেই অনুপাতে বাড়ছে না।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মেইল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের বক্তব্যে একদিকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে অসন্তুষ্টির পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রশংসাও উঠে এসেছে।
মাদারীপুর জেলার পূর্ব খান্দুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকুমার বেপারী বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে আমি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু আমরা যতটা দায়িত্ব পালন করি সে অনুযায়ী আমাদের আর্থিক সম্মান দেওয়া হয় না। কিছু দিন আগে আমাদের ১০ম গ্রেড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটির মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় যাবেন। তবে শিক্ষকদের আর্থিক সম্মাননার বিষয় যতটা ভালো হবে সেটার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষায়।’
শিক্ষকদের জন্য দেওয়া কিছু নির্দেশনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের খুবই সুসম্পর্ক হবে। এটির মাধ্যমে শিশুরা ভালো কিছু নিয়মিত শিখবে। আর শিক্ষক একজন অভিভাবকও বটে। ফলে শিক্ষকদের শাসন করার অধিকারও থাকা চাই।
‘বিগত সরকারের সময় থেকে শিক্ষকদের শাসন করার অধিকার কিছুটা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এটির মাধ্যমে শিখন পদ্ধতি কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয় তাতেও শিক্ষায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমন: এক পড়া দ্বিতীয় দিন পড়ানো যাবে না এমন একটি নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু স্কুলের সব বাচ্চারা একই ধরনের নয়। অনেক কিছু একাধিক দিন পড়ানোর প্রয়োজন হয়। এটি না করলে সব বাচ্চা ওই জিনিস হয়তো শিখতে পারবে না। ফলে শিক্ষকদের নিজেদের মতো করে পড়ানোর অধিকার দিতে হবে’।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা জরুরি
নওগাঁ জেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মধুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল গফুর বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় বৈষ্যমের জায়গা হলো সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বেতন স্কেলে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যখন নতুন শিক্ষক হিসেবে কেউ যোগদান করে তখন যে বেতন দেওয়া হয় সেটি খুবই নগন্য ও অমানবিক। এটি দিয়ে বর্তমান সময়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়।
‘মূলত রাষ্ট্র থেকেই এক ধরনের বৈষম্য করা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে দ্রুত এই বৈষম্যের দূর হওয়া উচিত। এছাড়া শিক্ষকতার জীবন শেষে অবসর ও কল্যাণ ভাতা নেওয়ায় যে দীর্ঘ ভোগান্তি সেটি কাম্য নয়।’

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের খুবই সুন্দর ও স্বচ্ছ সম্পর্ক থাকবে। যেখানে উভয় পক্ষের নৈতিকতাবোধও থাকবে। তবে দিন দিন শিক্ষার্থীদের আচরণ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে সেটা শিক্ষকদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেই তাদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে শিক্ষকদের
শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে
শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বৈষম্য আছে জানিয়ে রাজশাহীর তাহেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মো. নজরুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ‘আমরা একজন শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্তির স্কেলে বেতন পাই। কিন্তু অন্যান্য কিছু সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বৈষম্য রয়েছে। এসব বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু বিষয় বিবেচনা করেছেন।’
আরও পড়ুন: শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় আসছে নতুন নিয়ম
আগের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা ত্রুটি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। আগের প্রতিষ্ঠানের কমিটি, অর্থনৈতিক লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হতো, যাতে ভালো শিক্ষক পাওয়া যেত না। এছাড়া শিক্ষকদের যে পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্মননা দেওয়া হয় সে অনুপাতেও অনেকে পাঠদানসহ শিক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেন না এটি সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। অনেক সময় সরকার শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেন সেগুলো খুব ভালোভাবে শ্রেণি কক্ষে অনেকের পাঠদানে প্রতিফলিত হয় না।’
শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যেন ভয়ের না হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। তবে এটির মার্জিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু শ্রেণি কক্ষের ভেতরের বিষয় নয়, যেকোনো বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। কারণ কোনো ভয়ের সম্পর্কের মাধ্যমে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশে শিক্ষকরা মানসম্পন্ন বেতন পান না জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয় সেটি খুব মানসম্মত নয়। শিক্ষকদের বেতন আরও ভালো স্কেলে হওয়া উচিত। এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের।’
শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এক ধরনের পারস্পারিক সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকবে। এটিও এক ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মতো। এই সম্পর্ক যত আন্তরিক হবে উচ্চ শিক্ষার সফলতা তত বেশি হবে। এই সম্পর্কের ইতিবাচক একটা প্রভাব শিখন পদ্ধতিতেও পড়বে।
এএসএল/এমআর