মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৫ পিএম
দেশে মৌলিক শিক্ষায় বিভাজন ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৩ কোটি শিক্ষার্থী এক লাখ ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় পড়ালেখা করছে। তারা আটটি ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশোনা করছে-যার অনেকগুলোই নিজস্ব সিলেবাসে পরিচালিত। এর ফলে সমাজে ছোট থেকে বড় পরিসর পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে বিভাজন।
চাকরির বাজারে বৈষম্য, চিন্তার ফারাক, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের অসাম্য এবং চিন্তাধারার পার্থক্য দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। এই জটিলতা কাটাতে বড় ধরনের শিক্ষা সংস্কার এবং একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে তার শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা বলছেন, শিক্ষা সংস্কার না হওয়াই দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার বড় উদাহরণ।
শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস
ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারত উপমহাদেশে মূলত দুই ধারায় শিক্ষা চলত। ব্রিটিশরা শাসনের সুবিধার্থে শিক্ষায় বিভাজন শুরু করে। এর আগে কলকাতায় ১৮শ শতকেই আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু হয়, পরে তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কওমি মাদরাসা আরও পুরোনো হলেও ১৯৮০–৯০ দশকে গ্রামে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের শিক্ষানীতি অনুসারে সাধারণ বাংলা মাধ্যম শিক্ষা জোরদার করা হয়। ১৯৫৮ সালে প্রথম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৮০ দশকে কিন্ডারগার্টেনের যাত্রা শুরু হলেও ২০০০ সালের পর তা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ব্রিটিশ আমল থেকেই থাকলেও ১৯৯০ দশকের পর এর প্রসার সবচেয়ে বেশি। ২০১০ সালের পর দেশীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমও চালু হয়। কারিগরি শিক্ষার বিস্তার শুরু হয় ২০০০ সালের পর। এছাড়া এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন ছোট ধারার শিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হয়।
বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা
বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত (১ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি) কয়েক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। মূলত পাঠ্যক্রম, ভাষা এবং তত্ত্বাবধানের ভিত্তিতে এগুলো ভাগ করা হয়।
প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় রয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেড় কোটির বেশি শিক্ষার্থী, বেসরকারি ৩৭ হাজার বিদ্যালয়ে আরও প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। কিন্ডারগার্টেনে ৮ লাখের বেশি, এবং সাড়ে তিন হাজার ইবতেদায়ি মাদরাসায় রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী।
মাধ্যমিক স্তরে সরকারি ও বেসরকারি ২০ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে ৮১ লাখ শিক্ষার্থী, ১৬ হাজারের বেশি আলিয়া (দাখিল) মাদরাসায় ২৭ লাখের বেশি, কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ৭ লাখের বেশি এবং ইংরেজি মাধ্যমে প্রায় অর্ধ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
সামাজিক বিভাজন
শিক্ষায় এমন ধারায় সমাজের ছোট পরিসর থেকে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, শিক্ষা ব্যবস্থার বিভাজন সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। ধনী পরিবারগুলো সন্তানের সামাজিক পরিচয় উঁচুতে তোলার জন্য ইংরেজি মাধ্যম বেছে নিচ্ছে। ফলে সমাজে দুটি প্রধান শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। এতে সমাজে স্পষ্টভাবেই দুই ধরনের শ্রেণি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। মূল ধারার এই দুই ধারার সিলেবাস অনেকটা কাছাকাছি হলেও বেশ কিছু পার্থক্যও রয়েছে। এছাড়া আলিয়া ও কাওমি মাদরাসা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়াশোনা করান। এসবের কারণে সমাজের একাধিক চিন্তার মধ্যে দিয়ে শিশুরা বেড়ে উঠছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অধ্যক্ষ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের সিলেবাসের কনটেক্সটে অনেক কিছুর মিল থাকলেও পড়াশোনায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। দেশীয় ব্যবস্থায় বেশিরভাগ তত্ত্বীয় পড়াশোনা রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে দেশের বাইরের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশীয় মাধ্যমে পড়াশোনা করে বিদেশে বা আন্তর্জাতিক পরিসরে ভালো কিছু করার সুযোগ কম। কিন্তু বিদেশি বোর্ডের আওতায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা আছে। এর ফলে দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রথম পছন্দ এখন ইংরেজি মাধ্যম। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও সন্তানের ভালোর জন্য এই মাধ্যমে পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন।’
চাকরির বাজারে বৈষম্য
দেশে প্রতিবছর কয়েক লাখ গ্রাজুয়েট চাকরির বাজারে আসলেও সবার জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। এর মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই বেশি সুযোগ পায়। মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি অবহেলিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও বর্তমান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আল আমিন হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সেভাবে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। প্রত্যাশা ছিল একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করার। কিন্তু এগুলোতে ভালো পোস্টের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের আলাদা করে সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে বহু চেষ্টার পর একটা দেশীয় কোম্পানিতে ক্যারিয়ার শুরু করেছি।’
শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে জটিলতা
প্রতিটি ধারার আলাদা সিলেবাস ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে জটিলতা তৈরি হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান দেশের নিয়মকানুন মানে না-বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম ও কাওমি মাদরাসা।
ইংরেজি মাধ্যমের ওই অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমাদের স্কুলের কারিকুলাম চলে আন্তর্জাতিক পরিসরের তাই দেশীয় বোর্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া আমাদের শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন সব কিছু ভিন্ন রকমের।’
মাউশির সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষায় এত বেশি শাখা ও সমস্যা রয়েছে যে কেউ হাত দিতে চায় না। ফলে প্রতিনিয়ত সংকট বাড়ছে।’
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সাবেক সচিব ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একটি দেশের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের মৌলিক স্তরের শিক্ষায়ও বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। এসব একমুখি করা খুবই কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। কোনো সরকার যদি শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের চিন্তা করে তাহলেই কেবল এটা সম্ভব। এসবের জন্য একটা স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজন। যারা শুধু রিপোর্ট দিবে না বরং দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা অনুসারে মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির জন্য নিয়মিত কাজ করবে।”
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান দেশের অবস্থা অনুসারে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে এক ধরনের স্কুল তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে মৌলিক শিক্ষার বেসিক জায়গা ও কারিকুলাম সবার জন্য নির্দিষ্ট হবে। আর পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও হতে হবে মানসম্মত। তবে এখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষায় বিভাজন থাকার ফলে আমাদের সমাজও বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার এত কিছুর সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শিক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শিক্ষা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছেই। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এখানে হাত দিতে চান না। কারণ এটি না করেও তাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে। শিক্ষা সংস্কার না হওয়া হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।’
মনজুর আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এটা সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে একটা স্পর্শকাতর বিষয়ও রয়েছে, সেটা হলো ধর্মীয় লোকজন চায় এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা। আবার অনেকেই চায় সেক্যুলার একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। এসব কারণে হয়তো অন্তর্র্বতীকালীন সরকার এখানে হাত দেয়নি। সমস্যা থাকবেই কিন্তু এসবের জন্য আলাপ-আলোচনা করে একটা সমাধানের পথে যেতে হবে।’
এএসএল/এমআর