মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
১৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:১১ পিএম
‘আমার মেয়ে নাজিয়া ও ছেলে নাফি মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী। মেয়েকে জোর করে কোচিংয়ে নেওয়া হয়। দুর্ঘটনার দিন ক্লাস শেষে কোচিংয়ের ক্লাসই করছিল মেয়ে নাজিয়া। ক্লাসের বাইরে অপেক্ষায় ছিল নাফি। অনেকক্ষণ পর নাজিয়া না আসায় বোনকে খুঁজতে যায় সে। সেখানে ভাই-বোন মারা যায়।’
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দুই সন্তানকে হারানোর বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন তাদের বাবা আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘যদি কোচিং বাণিজ্য না চালাতো, তাহলে আমার ছেলে-মেয়ে বেঁচে থাকত।’
রোববার (১৭ আগস্ট) সন্তানহারা একদল অভিভাবক ৯ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দিতে মাইলস্টোনে আসেন। এদিন দুপুর ১২টায় তারা স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য স্কুলে প্রবেশ করতে গেলে বাধা দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত এক শিক্ষার্থীর মা বলেন, তার মেয়ে স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। স্কুলের মাসিক ফি ১৭০০ টাকা দিতে হয়। শুরুতে মেয়েকে স্কুলের কোচিংয়ে না দিলেও পরবর্তীতে শিক্ষাকরা বারবার ফোন করে কোচিংয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কোচিংয়ে ভর্তি করান। তার জন্য অতিরিক্ত আরও ২৫০০ টাকা দিতে হয়।
এই কোচিং না করলে মেয়ে বেঁচে থাকত বলে দাবি করেন তিনিও। বাধ্যতামূলক এই কোচিংয়ের বিষয়ে অভিযোগ আরও অনেক অভিভাবকের।
এদিন স্কুলে এসে অভিভাবকরা নিরাপত্তা প্রহরীদের জানান, তারা কেউ নাজি ও নাফির বাবা, কেউ ফাতেমার মামা, কেউবা রাইসার মা। তারা আগেই অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতিও নিয়েছেন। কিন্তু তাদের এমন পরিচয় ও পূর্বানুমতির বিষয়টি জানানোর পরও জবাবে নিরাপত্তা প্রহরীরা সাফ জানিয়ে দেন, ‘ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই।’

সরেজমিন দেখা যায়, দুপুর ১২টার দিকে স্কুলের গেটে ১৫-১৬ জন অভিভাবক জড়ো হোন। এক পর্যায়ে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য স্কুলে প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তা প্রহরীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে তারা জোর করে স্কুলে প্রবেশ করেন।
এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও স্মারকলিপি গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ
বহু কষ্টে অভিভাবকরা ভেতরে প্রবেশ করলে তাদের প্রশাসনিক ভবনের কনফারেন্স রুমে বসতে দেওয়া হয়। কথা ছিল সেখানে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম, প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নুরন্ নবী, উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাসুদ আলম উপস্থিত থাকবেন।
তবে অভিভাবকরা ভেতরে প্রবেশের পর কর্তৃপক্ষ নতুন শর্ত দেয়। তাদের জানানো হয়, তিন-চার জনের একটি প্রতিনিধিদলই কেবল অধ্যক্ষ, উপদেষ্টা ও উপাধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। একই সঙ্গে সেখানে গণমাধ্যমের কেউ থাকতে পারবে না। এ শর্তে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেনি মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ।
অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের প্রশ্ন ও গণমাধ্যমকর্মীদের এড়াতে গোপনে অন্যদিক দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা এবং অধ্যক্ষ।
তবে বিষয়টি ‘সঠিক নয়’ বলে দাবি করেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল। তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে ভেতরে প্রবেশে বাধা দিইনি, কারও ভয়ে কেউ বেরিয়েও যাননি। এটা যারা বলছেন, সেটা সঠিক নয়।’
নিহত তানভীর আহমেদের বাবা বলেন, ‘আামদের প্রধান উপদেষ্টার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কথা বলতে দেওয়ার আগে ভয় দেখানো হলো যেন আমরা কোচিং করানো হয়- এমন কথা না বলি। অথচ এ স্কুলে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে কোচিংয়ে বাধ্য করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে মাইলস্টোনের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম, প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নুরন্ নবীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তারও ফোনকল রিসিভ করেননি।
স্মারকলিপিতে যে ৯ দাবির কথা উল্লেখ করেছেন অভিভাবকরা
১. বিমান দূর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে;
২. সারা বাংলাদেশে মাইলস্টোন স্কুল সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
৩. সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি নিহত বাচ্চার জন্য ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ (জরিমানা) এবং প্রতি আহতদের জন্য ১ কোটি টাকা দিতে হবে।
৪. স্কুলের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নিহত বাচ্চার জন্য ২ কোটি এবং প্রতি আহতদের জন্য ১ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৫. রানওয়ে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন করতে হবে (অন্যথায় রানওয়ের স্থান পরিবর্তন করতে হবে)।
৬. কোচিং ব্যবসার মূল হোতা স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষিকাকে (মিস খাদিজা) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তার সুষ্ঠু বিচার করতে হবে।
৭. স্কুলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আমাদেরকে দেখাতে হবে।
৮. বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জনহীন জায়গায় করতে হবে।
৯. নিহত শিক্ষার্থী বাবাকে যে শিক্ষক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে সেই শিক্ষককে অপসারণ করতে হবে।
গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ির স্থায়ী ক্যাম্পাসে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে এ পর্যন্ত ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। অনেকে এখনো চিকিৎসাধীন। তাদের কারও কারও অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়।
এএসএল/এএইচ