মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
২৫ জুলাই ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
সুবর্ণ, হেড ইন্টারন্যাশনাল ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্লে থেকে বর্তমানে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত একই স্কুলে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনা বাবদ তার বার্ষিক স্কুলের খরচ লক্ষাধিক টাকা। তার বাবা একজন কলেজের অধ্যাপক। তিনি বলেন, ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পড়াতে চাই। এ জন্য বাংলা মাধ্যমে পড়াইনি। এছাড়া বাংলা মাধ্যমের পড়াশোনা দিয়ে বিদেশ যাওয়া কঠিন হয়।
শুধু তিনিই নয়, এটি প্রায় পুরো রাজধানীবাসী অভিভাবকদের কথা। সবাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বাদ দিয়ে প্রাইভেট বিভিন্ন স্কুলে পড়াচ্ছেন সন্তানদের।
অভিভাবকরা জানান, সরকারি স্কুলের পরিবেশ ও অবকাঠামো ভালো নয়। এছাড়া শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ও ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনা অনেক আপডেট তাই সেদিক ঝুঁকছেন অভিভাবকরা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, একটি সন্তানের প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ধনী, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরাও প্রাথমিক শিক্ষায় বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করছেন। সেক্ষেত্রে ধনী অভিভাবকদের জন্যও বিষয়টি কষ্টকর না হলেও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে। আর সর্বশেষ যাদের সামর্থ্য হচ্ছে না তারাই বাধ্য হয়ে সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৩। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালে ১৩ লাখ ১০ হাজার শিক্ষার্থী ছিল এই জেলায়, যার মধ্যে প্রায় ৭ লাখ শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় অর্ধেকের বেশি।
>> আরও পড়তে পারেন
এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে ৩৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সরজমিনে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বিদ্যালয়ই জরাজীর্ণ ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। নেই কোনো খেলার মাঠ। এমনকি অনেক বিদ্যালয়ের জমিও বেদখল হয়ে গেছে।
শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
ব্যানবেইসের ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান’- এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে ইংরেজি মিডিয়ামে ঢাকায় শুধু ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে।
সন্তানদের ছোট অবস্থায় যত্নের প্রয়োজন বেশি। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেভাবে শিক্ষার্থীদের যত্ন নেওয়া হয় না। এতে ছোট বেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ব্যাপারে আনন্দ পায় না এবং শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে তারা অযত্নের প্রতিষ্ঠানে শিশুদের পাঠাতে চায় না।
খরচের পার্থক্য ১০০ গুণ, তবুও ঝোঁক ইংরেজি মাধ্যমে
ইংরেজি মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য বছরে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। এছাড়া স্কুল ভেদে এই খরচ কয়েক লাখ টাকাও হয়। এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া ভালো মানের প্রাইভেট স্কুলের ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতাও রয়েছে। উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের কাছে সন্তানের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা এখন ‘সামাজিক মর্যাদার’ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান শিক্ষাবিদরা।
সুবর্ণের বাবা অধ্যাপক আসাদুল ইসলাম বলেন, আমি বাচ্চার উচ্চ শিক্ষা ও ভবিষ্যতের চিন্তা করে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করিয়েছি। বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও পড়াশোনার অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। বাংলা মাধ্যমে পড়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সিলেবাসের স্কুলে পড়ালে তার জন্য বিদেশ যাওয়া সহজ হবে।

খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, ইংরেজি মাধ্যমে খরচ কিছুটা বেশি। কিন্তু বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেদিক খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। আর বাংলা মাধ্যমের সিলেবাসের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের সিলেবাস অনেক ভালো।
একই ধরনের কথা বলেন আরেকজন অভিভাবক তাসলিমা বেগম। তার মেয়েকেও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার ঝোঁক দেশের অভিভাবকদের মধ্যে বেড়েছে এটা সত্য। উচ্চবিত্তরা অনেকে মনে করেন ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের পড়াশোনা করানো সামাজিক মর্যাদার মতো। তাই এই প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে।
রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যত সংকট
রাজধানীতে মাত্র ৩৪১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব স্কুলে শিক্ষার গুণগত মান হলো সবচেয়ে বড় সংকট। এছাড়া বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ও নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে খুব বেশি জবাবদিহিতার জায়গা না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার মান প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
মিরপুর-১১ এর আনন্দ নিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়া উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৫শ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক আছে মাত্র ৭ জন। আমরা শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তার আবেদন করেছি।
>> আরও পড়তে পারেন
রাজধানীর অভিভাবকরা জানান, সন্তানদের ছোট অবস্থায় যত্নের প্রয়োজন বেশি। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেভাবে শিক্ষার্থীদের যত্ন নেওয়া হয় না। এতে ছোট বেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ব্যাপারে আনন্দ পায় না এবং শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে তারা অযত্নের প্রতিষ্ঠানে শিশুদের পাঠাতে চায় না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রাইভেট বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। তারা মনে করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট স্কুলে ভালো পড়াশোনা হয়। তাই এই ধারণা ভাঙার জন্য কাজ করতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ, অবকাঠামোগতসহ বিভিন্ন সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। তারপর শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তিতে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করা যাবে। এছাড়া নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন ও জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষার বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী রেজা বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য দৃষ্টিনন্দন বিদ্যালয় তৈরিসহ বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ করছি। আশা করি ঢাকার মধ্যে বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে।
এএসএল/এএস