বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শাহ আজিজুর রহমান হলের পুকুর থেকে সাজিদ আব্দুল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে শাহ আজিজুর রহমান হলের পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার আকস্মিক মৃত্যুতে ক্যাম্পাসজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। একইসঙ্গে তার মৃত্যু ঘিরে দানা বেঁধেছে রহস্য— উঠছে নানা প্রশ্ন।
জানা গেছে, সাজিদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শহিদ জিয়াউর রহমান হলে থাকতেন। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলায়। তার বাবা মুহাম্মদ আহসান হাবিবুল্লাহ দেলোওয়ার একটি মাদরাসার সুপারিনেটনডেন্ট।
এই ঘটনায় আশপাশের এলাকায় যত সিসি ক্যামেরা ছিল সব অকার্যকর। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুর্বলতাকে দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ করে তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি সিসি ক্যামেরা ব্যতীত সব অচল। কে সাজিদকে মেরেছে সেটা তো দূরের কথা, কীভাবে মরেছে সেটা বের করতে ইবি প্রশাসন ব্যর্থ। দুই হল সংলগ্ন পুকুরে সে হেঁটে গিয়েছে কিনা এটা বের করতে পারলে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ আর ধোঁয়াশা কাজ করতো না। সিসি ক্যামেরা থাকলে সহজেই বিষয়টি উদ্ঘাটন করা যেত।
এই ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইবি কর্তৃপক্ষ ও শহীদ জিয়াউর রহমান হল। সেখানে আগামী ১০ কার্যদিবসের ভিতরে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ইবি ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন।
জানা গেছে, গতকাল শাহ আজিজুর রহমান হলের সামনের পুকুরে তার ভাসমান লাশ দেখা যায়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পুলিশ এসে লাশ তুললে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। এরপর তাকে কেন্দ্রীয় চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হলে জরুরি বিভাগের ডা. সুতপা রায় তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদিকে আজ সকাল ১০টার দিকে তার ময়নাতদন্ত শেষ করা হয়। পরবর্তীতে মরদেহটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং বেলা ১২টার দিকে সদর হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের সামনে জানাজার আয়োজন করা হয়। তবে জানাজার পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ না দেওয়া পর্যন্ত লাশ ছাড়া হবে না বলে ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। এসময় প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একটি লিখিত আশ্বাস দেওয়া হলে মরদেহটি গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। লিখিত আশ্বাসে, নিহতের আকস্মিক মৃত্যুর বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত এবং সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। এছাড়া আগামী ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে এই তদন্ত কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী পুকুর পাড়ে অবস্থিত দোকানী আকমল বলেন, দুপুর ১টার দিকে দেখি কী যেন একটা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল প্যান্ট ভেসে আছে। পরে আসরের দিকে দেখি মাথা ভেসে উঠেছে। তখন বিষয়টি জানাজানি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সাজিদ ফুটবল খেলে। এই সময়ে তখন ইবিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। পরে খেলা শেষে সাজিদ জিয়া মোড়ের দিকে আসে। তখন প্রচুর বৃষ্টির ফলে জিয়া মোড়ে হাঁটু সমান পানি জমে যায়। এই সময় জিয়া মোড়ে আবদুল আলিম নামে এক ফাস্টফুড বিক্রেতার সঙ্গে সাজিদের কথা হয়। তিনি জানান, সাজিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো ভাই পানি তো অনেক উঠে গেছে, দোকান কীভাবে খুলবেন? পরে আলিম সাজিদকে বলে এ কোনো সমস্যা না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। এরপর সাজিদ তার দোকানের পাশেই একটি টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু সময় পরে সাজিদ সেখান থেকে চলে আসে। এই সময় সাজিদ একাই ছিল।
আলিম আরও জানান, সাজিদের লাশ যে পোশাকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই পোশাকেই ১৬ জুলাই সাজিদকে দেখা গেছে।
এদিকে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী জাফর বলেন, আমি ১৭ জুলাই হল ডাইনিংয়ে যাওয়ার সময় সাজিদকে দেখেছিলাম বোধহয়। তবে সেটি ১৬ তারিখও হতে পারে; তখন মনে হচ্ছিল ওর খুব মন খারাপ।
দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী ইনসান বলেন, মৃত্যুর খবরের আগে সাজিদকে বিকেল ৫টার দিকে কল দেই। সাজিদের ফোনে কল ধরা হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড হ্যালো হ্যালো করলেও সাজিদের ফোন থেকে কেউ কথা বলেনি।
সাজিদের বন্ধু মুহিববুল্লাহ নোমান তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, সবকিছু কেমন জানি ধোঁয়াশা লাগছে, কিছুই ঠিকঠাক আঁচ করতে পারছি না। সাজিদ, আমি, ইনসান, উসামা, ইমরান, আজহার— আমরা একসঙ্গে আড্ডা দেই, ক্যাম্পাসে চলাফেরা করি। ইনসান গতকাল দুপুরে উত্তম দাদার সৎকারের জন্য দিনাজপুর গেছে। আজ সকালে ফিরেছে। মাঝে সাজিদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। সাজিদের সঙ্গে আমার শেষবার দেখা হয় জিয়া মোড়ে। সে পাবলিক অ্যাডের আল আমিন ভাইয়ের সঙ্গে খালুর দোকানে গল্প করছিল। আমি ফোনে কথা বলতে বলতে হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়েছিলাম আমি ব্যস্ত আছি, পরে দেখা হবে।
এদিকে আজহার সাজিদকে ফোন দিয়ে পায়নি। ম্যাসেজও দিয়েছিল। বিকেলে (পাঁচটার দিকে) প্রোগ্রামে যাওয়ার পথে তাকে ডাকতে এসে দেখে সে রুমে নেই, দরজায় তালা ঝুলছে। তারপর সে প্রোগ্রামে চলে যায়। আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
ব্যাপার হলো, ইমরান সাজিদকে রাত ৮:৪৮-এ ফোন করে। ফোন রিসিভ হয় কিন্তু কোনো শব্দ আসে না। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়।
অনেকে বলাবলি করছেন, খেলা শেষে সন্ধ্যায় গোসল করতে গিয়ে কোনোভাবে পানিতে ডুবে সে মারা গেছে। তাহলে ইমরানের ফোনকল কে রিসিভ করল? তাও কি না পরপর দুইবার রিসিভ করা হয়েছে কিন্তু কোনো শব্দ আসেনি— এমনটা ইমরানের ভাষ্য।
সাজিদের লাশ উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফিলতি আছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গতকাল আমরা লাশ দেখে প্রশাসনকে জানিয়েছি। আমাদের জানানোর প্রায় পৌঁনে এক ঘণ্টা পর সেই লাশ উদ্ধার করা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থানা থাকার পরেও পুলিশ আসতে এত সময় লাগলো কেনো? এছাড়া লাশ উঠানোর প্রায় আধা ঘণ্টা পার হলেও সেখানে কোনো ডাক্তার বা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসা হয়নি। পরে আমরা বাধ্য হয়ে ভ্যানে করে তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাই। পরে তাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারা আরোও অভিযোগ করেন, লাশ শনাক্তের দুই ঘণ্টার মধ্যেও প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা কিংবা হল প্রভোস্টের দেখা মেলেনি। যদিও রাত ৯টার পর ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম এবং শহীদ জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক গফুর গাজি এসে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে কোনো সিসি ক্যামেরা সচল নেই। এখন আমরা দেখতেও পাচ্ছি না, সে কখন কোথায় গিয়েছে। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নিরাপত্তার ঘাটতি মোটেও কাম্য নয়। আমরা প্রশাসনকে বারবার বলার পরেও তারা বাজেট ঘাটতির কথা বলে সিসি ক্যামেরা লাগাচ্ছে না। তাদের যদি এতই ঘাটতি থাকে তাহলে আমাদের বলুক আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে সিসি ক্যামেরা লাগাব।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় এত টাকা দিয়ে প্রভোস্ট কোয়ার্টার বানিয়েছে। যেখানে কোনো প্রভোস্ট বা আবাসিক শিক্ষক থাকে না। অফিস সময়ে হলের প্রভোস্টদের দেখা মিললেও আবাসিক শিক্ষকদের তো হলে দেখাই যায় না।
অর্জুন দাস নামের এক শিক্ষার্থী ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘এ প্রশাসন কি আদৌও শিক্ষার্থীবান্ধব? যে প্রশাসনের সকলে শহরে থাকেন, ক্যাম্পাসে আবাসন ব্যবস্থা থাকার পরও। তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দেবে? একটা তাজা প্রাণ চলে গেল; তবুও প্রশাসনের টনক নড়লো না। তারা কি আদৌও শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে চলে?’
সাব্বির নামের এক শিক্ষার্থী ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘ভিসি কিংবা প্রো-ভিসি কেউই সাজিদের মরদেহ একবার দেখতে পর্যন্ত আসেননি— এটা কি একান্তই অবহেলা, নাকি ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতা? আমরা লজ্জিত, ক্ষুব্ধ এবং গভীরভাবে মর্মাহত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি রইলো তীব্র ধিক্কার। আজ সাজিদ, কাল আরেকজন— এই যদি হয় চিত্র, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কি লাভ?’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. শাহিনুজ্জামান বলেন, সাজিদ শহীদ জিয়াউর রহমান হলে থাকতেন। পুকুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কীভাবে মারা গেছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হল প্রশাসন ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কাজ চলমান। সাজিদের পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। সবকিছুর প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আমরা প্রকৃত ঘটনা জানতে পারব।
সাজিদের বাবা আহসান হাবিবুল্লাহ এসেছিলেন কুষ্টিয়ায় ছেলের জানাজায়। তিনি বলেন, আমার ছেলের মৃত্যু রহস্যজনক। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
সুরতহাল প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক হোসেন ইমাম বলেন, প্রাথমিকভাবে তার শরীরে অপমৃত্যুর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে ভিসেরা রিপোর্ট আসার পর আমরা নিশ্চিত বলতে পারব।
ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে জরুরিভাবে গিয়ে দেখতে পাই মরদেহ পুকুরের প্রায় মাঝামাঝি ভাসছে। উদ্ধারের পর মারা গেছে না বেঁচে আছে এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কেন্দ্রে প্রেরণ করি। কর্তব্যরত ডাক্তার পরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করেছেন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ডা. সুতপা রায় বলেন, শিক্ষার্থীর মরদেহ আমাদের কাছে আনা হয়। সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ছিলেন। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। আমরা তাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছি। আরও আগেই মারা গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে সে পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্য কোনো কারণে মারা গেছে কি না তা খতিয়ে দেখতে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়েছে।