মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
১৮ জুন ২০২৫, ০৭:২৩ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক-প্রাথমিক বইয়ের জন্য একটি দরপত্র প্রকাশ করলেও কিছুদিন পর সেটির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনের ফলে সঠিক মাপের বই করা ও ছাপা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য মানহীন বই ছাপার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পেছনে প্রেস মালিকদের একটি চক্র কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত তাদের চাপেই দরপত্র পরিবর্তন করেছে এনসিটিবি। যদিও সংস্থাটির দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শেই দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে।
এর আগে গত বার নিম্নমানের বই ছাপিয়ে শতকোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠে অসাধু প্রেস মালিক চক্রের বিরুদ্ধে। সেই চক্রটিকে কাজ দেওয়ার জন্য এই দরপত্রের পরিবর্তন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রাথমিকের বই বিশেষজ্ঞরা জানান, আগের দরপত্রে যে মাপের মেশিনের শর্ত উল্লেখ ছিল সেটা হলো প্রাথমিকের বইয়ের আসল আকার। পরিবর্তন করে যেটি করা হয়েছে এতে সঠিক মাপ ও ছাপা সম্ভব নয়। ফলে আবার শিক্ষার্থীরা মানহীন বই পেতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, এবার এই বই ছাপায় বাজেট রয়েছে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকার কাজে ২২.৭৫ ও ৩৩.৫ ইঞ্চি ওয়েব মেশিন থাকার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তাতে সংশোধনী এনে মেশিনের আকার যথাক্রমে ২২ ও ৩২ ইঞ্চি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এটির পর থেকে বইয়ের মান নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী দেশের চারটি প্রেসের কাছে সঠিক মানের বই ছাপার ওয়েব মেশিন রয়েছে। একটি দরপত্রে তিনটি প্রেস প্রতিযোগিতা করলেই সেটি বৈধ হয়। কিন্তু প্রেস মালিকদের অসাধু চক্র যাদের কাছে ওই মানের ওয়েব মেশিন নেই তারা কাজ পাওয়ার জন্য একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে। যারা মূলত প্রেসার দিয়ে এনসিটির দরপত্র সংশোধন করে এবং লুটপাটের পথ তৈরি করে।
আরও জানা যায়, দরপত্র আহ্বানের পর বই নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অন্যদিকে একটি গ্রুপ দরপত্র পরিবর্তনের জন্য চাপও দিতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে সভা করে। যেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দরপত্র পরিবর্তনের পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন
পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ বিষয় না পড়াতে চিঠি: যা বলছেন শিক্ষকরা
গত বছরের বই নিয়েও সমালোচনা হয়। ওই বই ছাপার পর মান যাচাইয়ের জন্য হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসকে নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, লেটার এন কালার লি. সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের বই দিয়েছে। তারা ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে অতি নিম্নমানের ৬৯ ও ৭০ জিএসএমের কাগজ ব্যবহার করেছে। অনুপম প্রিন্টার্স ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে ৬১ জিএসএম, অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে ৭৩ জিএসএম, দ্য গুডলাক ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে ৭১ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করেছে।
প্রতিবদেন আরও বলা হয়, ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৫৯ জিএসএম, সুবর্ণা প্রিন্টার্স ৫৫ জিএসএম, অ্যারিস্টোক্র্যাটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ৫৬ জিএসএম, বর্ণমালা প্রেস ৫৮ জিএসএম, ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস ৬৩ জিএসএম, বর্ণমালা ৬০ জিএসএম, দোয়েল প্রিন্টার্স সাড়ে ৬৫ জিএসএম, রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৬৫ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন সদস্য ঢাকা মেইলকে বলেন, শুরুর দরপত্রে যে শর্ত ছিল তাতেই কেবল সঠিক মানের বই ছাপা সম্ভব। পরে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে শর্ত পরিবর্তন করা হয়। হয়ত মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের চাপ ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সঠিক মানের বই পাওয়ার জন্য উপযোগী মেশিনের মাপ দিয়েই দরপত্র আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু তাতে খুব অল্পসংখ্যক কোম্পানি কাজের জন্য সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পরামর্শে দরপত্র সংশোধন করা হয়েছে। এতে দেশের আরও বেশি প্রেস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সঠিক মানের বই ছাপানোর শর্ত দিয়েই দরপত্র প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান চিঠি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ গ্রহণ করে নতুন করে আবার দরপত্র প্রকাশ করি।'
এএসএল/জেবি