images

শিক্ষা

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ বিষয় না পড়াতে চিঠি: যা বলছেন শিক্ষকরা

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)

২২ মে ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম

দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে প্রথম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। তবে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে ৫ হাজার ৪০৬ জন শিক্ষার্থীর রয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ৪৭.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-বহির্ভূত (নন-স্টেম) বিষয়ে।

শুধু গোপালগঞ্জই নয়, একই পরিস্থিতি দেশের ১৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টিতেই। শুধু পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-বহির্ভূত কোনো অনুষদ নেই। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশের বেশিই পড়ছেন মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। অথচ এসব বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতসংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণাকে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতির বিষয়টি অনুধাবন করে গত ১৩ মার্চ বিশেষায়িত বিষয়ের বাইরে সাধারণ বিষয় পড়ানো বন্ধে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব নির্দেশনা সংবলিত চিঠি মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতসংশ্লিষ্ট সাধারণ বিষয় (STEM Subject) ছাড়া অন্য কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এরই মধ্যে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের বিষয়ের বাইরে অন্য বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান, তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ন্যূনতম সময়ের মধ্যে সীমিত অথবা বন্ধ করতে হবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৌশল ডিগ্রি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিষয় ও কোর্স পড়াতে হয়। সেদিক থেকে বিশেষায়িত অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও সামাজিক বিজ্ঞান, কলা অনুষদের বিষয় থাকতে পারে। তবে সেটি বর্তমানে যে পরিমাণ এমন নয়। বরং সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ থাকতে পারে। লেজুরবৃত্তিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগ খুলে নিজেদের লোকজন নিয়োগ করেছেন। এটি বাঞ্চনীয় নয়। শুধু চিঠির মাধ্যমেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার সম্ভব নয় বলেও জানান তারা। 

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা জানান, মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে সুস্পষ্ট কোনো নির্দশনা নেই। আর এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক কমিয়ে নিয়ে আসাও সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও জানান তারা।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ১৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬০ হাজার ১৫৫ জন। তাদের মধ্যে কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে অধ্যয়ন করছেন ২১ হাজার ৩৯৭ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৩৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিভাগে ৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বিভাগে ৪৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২টি বিভাগে ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়টি বিভাগে ৪২ দশমিক ৯০ শতাংশ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ বিভাগে ৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিভাগে ২৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি বিভাগে ২১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি বিভাগে ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি বিভাগে ১৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে অধ্যয়নরত।

du

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সংক্রন্ত চিঠি ইস্যু করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সব বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির সঙ্গে বৈঠক করার দরকার ছিল। আসলে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে কী কী ধরনের সমস্যা হতে পারে এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় এসব ব্যাপারও জরুরি। আলাপ না করেই এমন ব্যাপারে চিঠি ইস্যু করলে সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়ে গেছেন। চাইলেও তাদের সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় পড়ানো দরকার। এটি না হলে তারা শুধু প্রকৌশলী হবেন কিন্তু তাদের মানবিক বিকাশ ঘটবে না। মানবিক বিকাশ না ঘটলে তারা হয়তো ভালো প্রকৌশলী হতে পারবে কিন্তু সমাজের খুব বেশি কাজে আসবে না। তাই তাদের মানবিক বিকাশ ঘটনোর জন্য কিছু বিষয় থাকা দরকার আছে। তবে সেটি ২৫ শতাংশের বেশি নয়।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, শুধু চিঠি দিয়ে এসব সংস্কার করা যায় না। আলোচনা করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়। ঢালাও পরিপত্র দিলে খুব ভালো কিছু হয় না। যেসব বিষয়ের দরকার নেই এসব বিষয় পর্যালোচনা করে একটা ভালো সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর বলেন, শুধু একটা চিঠি এসেছে। পরবর্তীতে সেভাবে কোনো আলোচনা বা পদক্ষেপের কিছু বলা হয়নি। আর চাইলেই আমরা একটা বিভাগ বন্ধ করে দিতে পারি না। কারণ সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই রয়েছে।

ISPR

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এনামউল্যা বলেন, আমরা চিঠি পেয়েছি। তবে এটি একদিনে সম্ভব নয়। আমরা একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এছাড়া সরকার থেকে এসব বিভাগের বরাদ্দ কমালে বা বন্ধ করলে স্বভাবিকভাবেই এসব বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এটি সরকারের হাতেই রয়েছে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এ এস এম কাসেমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। 

এএসএল/ইএ