images

শিক্ষা

৬ বছরে ১৫ বার এসেও পাননি বাবার অবসর সুবিধার ভাতা

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)

১১ মে ২০২৫, ০৭:০২ পিএম

হুমায়ুন কবির ছিলেন চন্দ্রা শখা হাই স্কুলের সরকারি কর্মচারী। ২০১৮ সালে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পরের বছর অবসর সুবিধা ভাতার আবেদন করে তার পরিবার। কিন্তু গত ছয় বছরেও সুবিধার টাকা এখনো পায়নি তারা। গত ছয় বছরে প্রায় ১৫ বারের মতো ঢাকায় এসেছেন মৃত হুমায়ুন কবিরের ছেলে জসিম উদ্দিন। কয়েক বার কাগজ সংকটের কথা বলে অফিস এবং পরবর্তী সময়ে কিছু দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্যরা। কিন্তু সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন আর হয়নি।

জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন, আসলে ২০১৯ সালে আবেদনের পর আমাদের তদবির করার মতো লোক ছিল না, তাই টাকা পাইনি। এছাড়া আবেদনপত্রের কোনো সমস্যা থাকলে ফোন করে জানানো নিয়ম। কিন্তু আমাদের ফোন করে কিছু জানানো হয়নি বরং অফিসে এলে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হতো।

শুধু তিনিই নন, এই রকম ভোগান্তিতে দেশের প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। আর্থিক সংকটে দিন কাটালেও তারা অবসর ভাতা পাচ্ছেন না। কবে পাবেন সেটাও জানেন না। অনেকে অবসর ভাতার সুবিধা ভোগ না করেই দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষকের আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এই শিক্ষকদের অবসর ভাতা দিতে প্রয়োজন প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

তদবিরের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়েছে দিয়েছেন অবসর বোর্ডের বর্তমান সচিব (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক জাফর আহমদ।

ভুক্তভোগী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘গত ছয় বছরে আমি প্রায় ১৫ বার ঢাকায় এসেছি বাবার টাকার খোঁজ নিতে। প্রথম কয়েক বার বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। তারপর প্রতিবার বলা হয় আর কিছুদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। সর্বশেষ গত ৫ মে এসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্যা বলায় সেটির স্টেটমেন্টও দিয়েছি। এবার দ্রুতই হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা।’

সরকারি কর্মচারীর এই ছেলে বলেন, ‘ঢাকায় এই একটা কাজের জন্য এসে এসে বিরক্ত হয়ে গেছি। অনেক দিন আসিনি। তারপর গত ৫ মে এসেছিলাম। দেখি এবার কী হয়।’

আরও পড়ুন

চার বিসিএসের চাপে বিপর্যস্ত পিএসসি

সংশ্লিষ্টরা জানান, অবসরের পরপরই অবসর সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবতা হলো শিক্ষক-কর্মচারীদের এসব সুবিধা পেতে এখন চার বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের হাহাকার দিন দিন শুধু বাড়ছেই।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বর্তমানে ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকা রয়েছে ভাতা প্রদান বাবদ। এই অর্থ দিয়ে ২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত যারা আবেদন করেছেন তাদের নিষ্পত্তি করা যাবে।

সারাদেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা দেওয়া হয় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।

রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে কল্যাণ ট্রাস্ট ও বোর্ডের কার্যালয়। গত বুধবার (৮ মে) দুপুরে এই ভবনে গেলে দেখা যায়, বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাদের স্বজনেরা এসেছেন অবসর সুবিধার টাকা পাওয়ার খবর নিতে। কর্মকর্তারা তাদের বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। তার মধ্যে একজন ছিলেন জসিম উদ্দিন।

অবসর সুবিধার টাকা যেভাবে আসে

অবসর সুবিধার বড় অংশই আসে মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে। বর্তমানে অবসর সুবিধার জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটা হয়। এছাড়া সরকার মাঝে-মধ্যে থোক বরাদ্দ দেয়। এফডিআরের লভ্যাংশ এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে কেটে রাখা টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর টাকা দেওয়া হয়।

RR

অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৬ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে মাসে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা আদায় হয়। এফডিআর থেকে মাসে আয় হয় পাঁচ কোটি টাকা। এই খাতে মাসে আয় হয় ৮০ কোটি টাকা, যা বছরে ৯৬০ কোটি টাকা। কিন্তু শুধু অবসর–সুবিধার জন্য মাসে প্রয়োজন হয় ১২০ এবং বছরে এক হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এই হিসাবে বছরে ঘাটতি ৪৮০ কোটি টাকা। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন বছরে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষকের আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এগুলো সব আবেদন এখন নিষ্পত্তি করতে হয়, এতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এরপর স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলে কাউকে আর অবসর–সুবিধার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

আরও পড়ুন

উপাচার্য ছাড়াই চলছে সরকারি-বেসরকারি ৪১ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম

বর্তমানে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রায় দুই হাজার ৫০০ শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টাকা দেওয়া হয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষককে টাকা প্রদান করা হবে।

শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা তহবিলের ঘাটতি মেটাতে মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২১ সালের পর থেকে টাকা আদায় করা হলেও সেটি এখনো অবসর বোর্ডে আসেনি বলে জানান বর্তমান সচিব।

ফান্ড সংকটে দেওয়া যাচ্ছে না টাকা

অবসর বোর্ডের বর্তমান সচিব (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক জাফর আহমদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে ফান্ড না থাকার কারণে টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশাল একটা ঘাটতির মধ্যে রয়েছে বোর্ড। তাই টাকা থাকাসাপেক্ষে আমরা আবেদনের ক্রমিক নম্বর অনুসারে টাকা দিচ্ছি।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আবেদনের ক্রমিক নম্বর ছাড়া আগে টাকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সিরিয়াল মেইনটেইন করে একটা বোর্ডের মাধ্যমে টাকার অনুমোদন করা হয়। ফলে এখানে জালিয়াতির সুযোগ নেই।’

বোর্ডের অর্থ সংকট মেটানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মূল বেতন স্কেল বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিগত অনেক বছরের ঘাটতি পড়েছে বোর্ডে। ফলে আমরা নিয়মিতভাবে টাকা দিতে পারছি না। বর্তমানে সরকার যদি কোনো অনুদান দেয় তাহলেই কেবল সম্ভব দ্রুত সব আবেদন নিষ্পত্তি করা।’

এএসএল/জেবি