বোরহান উদ্দিন
১৫ জুলাই ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত দুই সপ্তাহ ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এত দিন আন্দোলন নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও তা সংঘাতে গড়ায়নি। এবার সেই আন্দোলন সংঘাতে রূপ নিল। সোমবার (১৫ জুলাই) দিনভর কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি ক্যাম্পাস। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ মুখোমুখি অবস্থানে থাকায় সংঘাত আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রোববার (১৪ জুলাই) রাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে জড়িতদের ওপর হামলার অভিযোগ আসতে শুরু করে। সোমবার (১৫ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দিনভর দফায় দফায় ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা। এতে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এই পরিস্থিতিতে সামনের দিকে কোটা আন্দোলন কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আন্দোলনের মুখে তখন সরকার সব ধরনের কোটা বাতিল ঘোষণা করে। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়ে সেই কোটা পুনর্বহাল হওয়ার পর আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও পরে ৫ শতাংশ কোটা রাখার এক দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করে। এরই মধ্যে শাহবাগে গত বৃহস্পতিবার বিক্ষোভকালে পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুরের অভিযোগে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যা নিয়ে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা।
অবশ্য সোমবারের আগ পর্যন্ত কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে সবকিছু শান্তিপূর্ণই ছিল। কোটা সংস্কারের দাবি ও নিজেদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল রোববারও রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেয় আন্দোলনকারীরা। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়।
রণক্ষেত্র ঢাবি এলাকা
গত দুই সপ্তাহ ধরে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। এটি নতুন মোড় নেয় গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেছেন এমন অভিযোগ তুলে গভীর রাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাতে হল ছেড়ে বাইরে বের হয়ে বিক্ষোভ করেন।
দিবাগত রাত চারটার দিকে সমন্বয়কদের একজন প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করবেন বলে ঘোষণা দেন। কেন্দ্রীয়ভাবে তা ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে হওয়ার কথা জানানো হয়। এদিকে বিকেলে একই স্থানে বিক্ষোভের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। ফলে সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করে।
দুপুর গড়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল থেকে শুরু হয় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ইট পাটকেল ছোড়াছুড়ি। পরে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প নিয়ে শোডাউন করেন। আন্দোলনকারীদের যেখানে পাওয়া গেছে সেখানেই তাদের ওপর চড়াও হন তারা। হামলার হাত থেকে রক্ষা পায়নি নারী শিক্ষার্থীরাও। ফলে মুহূর্তে পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
অবশ্য আন্দোলনকারীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। সন্ধ্যার আগে কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হলের দিকেও সংঘর্ষ হয়। যেখানে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ছাত্রলীগের হামলায় এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
এদিকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী ওয়াসিফ ইনান বলেছেন, রাজাকার স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করেছে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ আরও বেশ কিছু ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের নেতৃত্বে এ হামলা করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাঁজোয়া যানসহ ঢাবি ক্যাম্পাসে পুলিশ
এদিকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে সাঁজোয়া যানসহ দাঙ্গা দমনের সাজে সজ্জিত হয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন কয়েকশ পুলিশ সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকা পুলিশের দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার। তাকে শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।
এসময় শহীদুল্লাহ হলের কিছু বিক্ষুব্ধ ছাত্র বাইরে এসে হলে ঢুকে তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ করেন। পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ এ সময় তাদের পাশে ছিল না বলে অভিযোগ তাদের।
পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের যা বলবে আমরা সেভাবে কাজ করব। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে এসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
বিইউ/জেবি