নিজস্ব প্রতিবেদক
০১ জুন ২০২৩, ০৪:৪৪ পিএম
যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৮১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেলে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী এই প্রস্তাব পেশ করেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে আমরা সকল মাধ্যম অর্থাৎ সড়ক, সেতু, রেল, নৌ ও আকাশপথের সমন্বিত উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো- অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপদ, টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী যোগযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে, বর্তমানে চলমান কার্যক্রমগুলোর সময়ানুগ বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নোত্তর মান সংরক্ষণের ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।
সড়ক-মহাসড়ক-সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আমরা সড়ক, সেতু, কালভার্ট ও ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণের ফলে সারাদেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুগঠিত মহাসড়ক তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বিঘ্ন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশজুড়ে প্রায় ৭১৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ৪ বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিভিন্ন মহাসড়কে ১ হাজার ৫৫৮টি সেতু ও ৭ হাজার ৪৯৮টি কালভার্ট নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে ১৫টি রেলওয়ে ওভারপাস ও ১৮টি ফ্লাইওভার। যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করেছে। সামনের দিনগুলোতে সারাদেশে ২ হাজার ৩৪২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের উভয় পাশে সার্ভিস লেনসহ ৪-লেনে উন্নীতকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে বাস্তবায়িত দেশের ৮টি বিভাগের ২৫টি জেলায় মোট ১০০টি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৪৯৪ মিটার। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বের দরবারে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছি, আমাদের আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হয়েছে। সেতুটি একদিকে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সারাদেশের দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে অন্যদিকে সেতু থেকে সরকারের কর-বহির্ভূত রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সড়ক টানেল নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। শিগগিরই এটিকে যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি পর্যন্ত র্যাম্পসহ ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ জুন ২০২৪ এর মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। গাজীপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি লেন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে এবং কিছু অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এবং প্রায় সকল জাতীয় মহসড়কের সাথে সংযোগ তৈরি হয়ে ঢাকার সাথে ৩০টি জেলার যোগাযোগ স্থাপন সহজতর ও যানজটমুক্ত হবে।
যানজট নিরসন ও নিরাপদ সড়ক প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন এলাকার যানজট নিরসন ও দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে ৬টি মেট্রোরেল লাইনের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ শুভ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৫ সালের মধ্যে মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার পাতাল এবং নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার উড়ালসহ মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২১টি স্টেশন বিশিষ্ট মেট্রোরেলের আরেকটি লাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির রাখা হয়েছে।
মোস্তফা কামাল বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী-আফতাবনগর-দাশেরকান্দি রুটে ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে আমাদের। গাবতলী-কমলাপুর-নারায়নগঞ্জ এবং গোলাপশাহ মাজার-সদরঘাট রুটে উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে মোট ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের এই বিস্তৃতি যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণপরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।
রেলখাত উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে রেলখাতের উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২২ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৩৯ দশমিক ৭১ কিলোমিটার নতুন রেল লাইন নির্মাণ, ২৮০ দশমিক ২৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, ৭৩২টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ এবং ১৪৪টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। বর্তমানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ ইত্যাদি। সার্বিকভাবে, ৩০ বছর মেয়াদি ‘রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানের আওতায় সরকার রেলখাতের উন্নয়নে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে।
এছাড়াও বাণিজ্য সহায়ক নৌপথ ও বন্দর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ সমুদ্র বন্দরগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে স্থল ও নৌবন্দরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রফতানি বাণিজ্য এবং দেশি-বিদেশি বাণিজ্য সম্প্রসারণে অন্যতম লজিস্টিকস হলো বন্দরগুলো। ফলে শুরু থেকেই সমুদ্রবন্দর, নৌ ও স্থলবন্দর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ সাধনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রচেষ্টায় বন্দরগুলো জাহাজ আগমন ও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর সমুদ্রে কন্টেইনার সংরক্ষণ ও কন্টেইনার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বর্তমানে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। মোংলা বন্দরকে একটি আধুনিক সমুদ্র বন্দরে রূপ দেওয়ার জন্য কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, মংলা বন্দর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং, আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা, সহায়ক জলযান সংগ্রহ, নতুন জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পায়রা বন্দরকে একটি বিশ্বমানের সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
নৌ ও বহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের প্রস্তাব করছি। বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে ৮১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
টিএই/এইউ