নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ মে ২০২৩, ০৫:৩৫ পিএম
জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বাংলাদেশ শিগগিরই আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থা প্রবর্তিত ‘দি হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দি সেফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টালি সাউন্ড রিসাইক্লিং অব শিপস, ২০০৯ (দি হংকং কনভেনশন) এর অনুমোদন করবে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
বুধবার (১০ মে) ঢাকার মতিঝিলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সভায় এ কথা মন্ত্রী জানান।
নরওয়ের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক উপমন্ত্রী মিস রাগনহিল্ড সজোনার সিরস্টাড নেতৃত্বে দেশটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ওই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ দূষণ রোধ করতে না পারা, বিভিন্ন রকম দুর্ঘটনা এবং দেশে-বিদেশে নানা নেতিবাচক প্রচারের কারণে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ সেক্টর বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বর্তমানে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বাংলাদেশ পরিবেশগত, পেশাগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।
শিল্পমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রমকে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্প মন্ত্রণালয় জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের পরিচালনা, উন্নয়ন ও বিকাশের অংশ হিসেবে ২০১১ সালে ‘শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড শিপ রিসাইক্লিং রুলস্’ জারি করে এবং ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ আইন’ প্রণয়ন করে।
২০১৮ সালের বাংলাদেশ জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ আইনে এ সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে নরওয়ের সহযোগিতা কামনা করছে সরকার।
সভায় নরওয়ের উপমন্ত্রী রাগনহিল্ড সজোনার সিরস্টাড ‘হংকং কনভেনশন’ অনুমোদনে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই কনভেনশন অনুমোদনের ফলে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবে। নরওয়ে একটি জাহাজ নির্মাণকারী জাতি। মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় নরওয়েতে প্রচুর জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশি ইয়ার্ডগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারে।
এজন্য পরিবেশগত ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দি হংকং কনভেনশন’ ২০২৩ সালের মধ্যে অনুমোদন করা হলে বাংলাদেশ আরও দুই বছর সময় পাবে এ সংক্রান্ত শর্তগুলো প্রতিপালন করার জন্য। বাংলাদেশের শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের উন্নয়নে নরওয়ে বিগত এক দশক ধরে সহযোগিতা করে আসছে। ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে।
এ সময় বাংলাদেশের এই শিল্পের আধুনিকায়ন এবং সমুদ্র ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নরওয়ের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। সেই সঙ্গে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ কাজে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।
এ দিন সভায় শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের উন্নয়নে নরওয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কারিগরি সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে। আমরা গত ৮ মে তারিখে এ সংক্রান্ত একটি আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। এ সময় শিল্পের শ্রমিক ও জনবলের দক্ষতা বাড়াতে নরওয়ে থেকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা বাড়ানোর জন্য দেশটির উপমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
সভায় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন ইকটার-সেভেনডসেন, নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং নরওয়ের জাহাজ মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা, অতিরিক্ত সচিব মো. জাফর উল্লাহ ও শেখ ফয়েজুল আমীনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
‘হংকং কনভেনশন’ ২০০৯ সালে ৬৩টি দেশের কূটনৈতিক সম্মেলনে পাশ হয়েছিল। International Maritime Organization (IMO) এবং সদস্য রাষ্ট্র ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও Basel Convention এর পক্ষগণের সহায়তায় এই কনভেনশন পাশ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো- জাহাজগুলো বিভাজনের সময় পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের যেন কোনোপ্রকার ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করা।
‘হংকং কনভেনশন’ কার্যকর করার জন্য ইতোমধ্যেই ২০টি দেশ অনুসমর্থন করেছে। দেশগুলো হলো- বেলজিয়াম, দি রিপাবলিক অফ দ্যা কঙ্গো, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ঘানা, ভারত, জাপান, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পানামা, সায়াতোমি অ্যান্ড প্রিনসিপ, সার্বিয়া, স্পেন ও তুরস্ক এবং পর্তুগাল।
বাংলাদেশে চলতি বছর হংকং কনভেনশন কার্যকর করতে হলে ইয়ার্ডগুলোকে HKC Compliance ইয়ার্ড হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইয়ার্ডগুলোতে কনক্রিটের তৈরি অভেদ্য মেঝে থাকতে হবে, সুন্দর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়াও জাহাজ কাটিং জোন ও স্ট্যাকিং জোন সুন্দরভাবে মার্ক করতে হবে, মেডিকেল চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ট্রেনিং প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে, মেকানাইজডকার্যক্রমের জন্য ইকুইপমেন্ট (ক্রেনসহ) ও মেশিনারি সেটআপ থাকতে হবে। পাশাপাশি HAZMAT (Hazardous materials) সংরক্ষণাগার থাকতে হবে এবং শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়াও প্রতিটি জাহাজের বিপরীতে এসআরপি প্রদান, ইয়ার্ডগুলোর এসআরএফপি বাস্তবায়নক্রমে কমপ্লায়েন্স অর্জন, মনিটরিং, রিপোর্টিং, সার্টিফিকেশন করতে হবে।
>> আরও পড়ুন: জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ: শিল্পমন্ত্রী
‘হংকং কনভেনশন’ কার্যকর হলে বাংলাদেশ সম্ভাব্য যে সুবিধাগুলো পেতে পারে তা হলো- OECD দেশগুলো থেকে অনেক কম দামে জাহাজ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বাজারে রডের মূল্য কমে আসবে। পাশাপাশি এ শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য (Treatment Storage and Disposal Facility (TSDF) তৈরি ও পরিচালনার জন্য জাপান থেকে কারিগরি সক্ষমতা প্রাপ্তি এবং সফট লোন প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে ইয়ার্ডসমূহে কম দুর্ঘটনা ঘটবে, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সমুদ্রের পানি ও পরিবেশের বিপর্যয় রোধ হবে।
উল্লেখ্য, জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম প্রধান। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ১৬৭টি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ ইয়ার্ড রয়েছে। যারমধ্যে কার্যরত ইয়ার্ড ৫০টি। সবমিলিয়ে দেশের বার্ষিক জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি। এছাড়া বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলো পৃথিবীর ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাত করে থাকে।
দেশের সামগ্রিক আয়রন চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ আসে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ শিল্প থেকে। এই শিল্পে প্রায় ৩০-৫০ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছে এবং পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যদিকে দেশে ৬শ’র মতো রি-রোলিং স্টিল মিল রয়েছে, যেগুলো এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের যে পাঁচটি দেশ সবচেয়ে বেশি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ করে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে।
ডিএইচডি/আইএইচ