images

অর্থনীতি

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে জোয়ার এনেছে পদ্মা সেতু

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:৩৪ এএম

পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণের পরপরই এর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দুর্নীতি, রাজনৈতিক গুজব ছাড়াও বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু শত বাধা আর বিপত্তি পেরিয়েই ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু শুধুমাত্র একটি সেতুই নয়। এটি বাঙালির আত্মবিশ্বাস, সক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক, যা উদ্বোধনের আগেই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার অর্থনীতিতে জোয়ার এনেছে পদ্মা সেতু। শুধু যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাই নয়, পাল্টে যেতে শুরু করেছে এসব জেলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারা।

২০২২ সালের ২৫ জুন বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল দিয়ে পদ্মা সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন। বেলা ১২টার দিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও মুরাল-১ উন্মোচন করে দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উন্মোচন করেন।

যোগাযোগসহ বিভিন্ন কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এসব জেলায় বিনিয়োগে খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না উদ্যোক্তারা। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ার পর রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি সেখানে বিনিয়োগেও এগিয়ে আসছে বড় বড় কোম্পানিগুলি।

সেতু চালুর পর নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য এ অঞ্চলে জমি খুঁজছে শেলটেক, প্রাণ-আরএফএল, টিকে গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ এবং অপসোনিন ফার্মার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২১টি জেলায় নতুন করে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) স্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেছেন, মোংলায় বাস্তবায়নাধীন দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৩৮২ একর জমির ওপর নির্মিত হবে কুষ্টিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া ঢাকার নবাবগঞ্জে মাওয়ার কাছে প্রায় ৮০০ একর জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিকল্পিত শিল্পায়ন আরও গতিশীল হবে। এই অঞ্চলে এক কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

টিকে গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সীকম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেছেন, পায়রা ও মোংলা বন্দর কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চল আগে থেকেই ব্যবসার উপযুক্ত জায়গা। এখন পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।

দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও মৎস পণ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রফতানি বাজার ধরতে চায় ঢাকাভিত্তিক দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ। ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারপারসন ও এমজেএল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, অবকাঠামো সংকটে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজ, আলু, ডাল, বাদাম, সরিষা, সবজিসহ বহু পণ্য প্রক্রিয়াজাত হতো না। কৃষকরা সঠিক দাম পেতো না, আবার নষ্ট হতো। যদিও এসব পণ্য রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

২০১৯ সালে ভোলায় দেশের সর্ববৃহৎ সিরামিক শিল্প গড়ে তোলে শেলটেক গ্রুপ। স্থানীয় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার, সস্তা জমি ও পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ হওয়ার প্রত্যাশায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর ভোলায় নতুন করে শেলটেক নন-ডেনিম পোশাক কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে বলে জানান গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া বরিশালেও তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপনে জমি খুঁজছে গ্রুপটি।

দেশের ২০টি স্থানে ২৩টি কারখানা রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। দেশের বাইরেও রয়েছে ৫টি কারখানা। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো প্রডাকশন হাব নেই তাদের। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ওই অঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা ও হালকা প্রকৌশল শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে জানান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল।

এছাড়া মেঘনা গ্রুপ, হামীম গ্রুপ, মীর গ্রুপ এবং ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো প্রায় অনেক প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে পদ্মা সেতুর কারণে।

সেতু চালু হলে বৃহৎ শিল্পগ্রুপ নিটল-নিলয় যশোর ও বরিশালে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলুব আহমেদ। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি জানিয়েছেন, গ্যাস সংযোগ পেলে বরিশাল-ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ হবে পরবর্তী ম্যানুফ্যাকচারিং হাব।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি অপসোনিন ফার্মা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ২০২০ সালে বরিশালে ৫০০ একর জমিতে দেশের সর্ববৃহৎ ফার্মা প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে এ কারখানায় ১০০০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছেন অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান। তিনি বলেন, দারুণ সম্ভাবনার কারণেই এখানে বিপুল বিনিয়োগ করছি।

ষাটের দশকের শেষদিকে খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন প্রায় শিল্পহীন নগরী বলা যায় খুলনাকে। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর খুলনা আবার শিল্পোদ্যোক্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে এসেছে। অনেকেই শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কিনছেন। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেছেন, আমি নিশ্চিতভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছি। খুলনায় একটি নতুন পোশাক কারখানা স্থাপন করতে চাই। শুধু তাই নয়, আমার পরিচিত ব্যবসায়ীদেরকেও এ অঞ্চলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করব।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় প্রথম পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে যাতায়াত ব্যবস্থায়। বিলাসবহুল বাসগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে। পদ্মা সেতু চালুর পর নামিদামি ২০-২৫টি কোম্পানির প্রায় ৩শ বিলাসবহুল বাস সরাসরি যাত্রী পরিবহন করছে। সময় লাগছে মাত্র ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা, যা আগে লাগতো ৮-১২ ঘণ্টা। বরিশাল বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কি‌শোর কুমার দে বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে সড়কপথে যাত্রী বেড়েছে। গ্রিন লাইনসহ বিভিন্ন বিলাসবহুল বাস কোম্পানিগুলো এখন তাদের শাখা খুলেছে বরিশালে। আরামদায়ক ভ্রমণ ও যাতায়াত দ্রুততর হওয়ায় যাত্রী বেড়েছে কয়েকগুণ। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, অনেকেই জমি কিনছেন। এরই মধ্যে বিসিকে গার্মেন্টসসহ ৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স সবসময় ব্যবসায়ীদের পাশে আছে।

পদ্মা সেতুর সুবাদে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় আর খরচ কমে আসায় আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে মোংলা বন্দর দিয়ে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, দেশের একের পর এক বৃহৎ মেগা প্রকল্পের মালামাল মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মোংলা বন্দর এখন বিশ্ব মানের বন্দরে রূপান্তরিত হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকার গার্মেন্টস পণ্যসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মোংলা বন্দর ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।

একইসঙ্গে এ বন্দর ব্যবহার করে গাড়ি আমদানিতেও সুবিধা বেড়েছে। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মোংলা বন্দর স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান আরজু বলেন, এখন মোংলা বন্দর থেকে একটি গাড়ি ঢাকাতে নিতে ৩-৪ ঘণ্টা লাগে। আগে ৬-৭ ঘণ্টা লাগতো। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাতে গাড়ি নিতেও ৬-৭ ঘণ্টা লাগে। যে কারণে গাড়ি আমদানির জন্য আমরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হচ্ছি।

ডব্লিউএইচ/জেএম/এমআর