জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
০৬ অক্টোবর ২০২২, ০১:২৯ পিএম
দেশের বাজারে ডলারের দাম যখন কিছুটা কমতির দিকে তখন সেপ্টেম্বর মাসে ভাটার টান পড়েছে প্রবাসী আয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে যে রেমিট্যান্স এসেছে, তা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। মাত্র শেষ হওয়া মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। যা গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ কমেছে। একইসঙ্গে এই মাসে রফতানি আয়ও কমেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রেমিট্যান্স আয় এবং রফতানি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন না এলে উদ্বেগ এবং শঙ্কা বাড়তেই থাকবে। এমন অবস্থায় রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে বিকল্প পথ বা নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বছরে দুটি ঈদ বা উৎসবের মৌসুমে বাংলাদেশে সাধারণত সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে। ওই সময় ছাড়া গড়ে দুই বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এই খাতে আয় এতটা কমে যাওয়ার কারণ কী?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'গত অর্থবছরেই রেমিট্যান্সের নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে। আগের বছরের তুলনায় গত বছর রেমিট্যান্স গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ফলে রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি।'
এর পেছনে কারণ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ে অস্থিরতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়েই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপরে।
তবে প্রবাসী আয় কমতে থাকলেও গত মাসে ১০ শতাংশের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পেছনে আরও কারণ আছে বলে ধারণা করছেন সেলিম রায়হান। তার মতে, মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা রেমিট্যান্স কমার পেছনে একটা বড় কারণ হতে পারে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যে খোলাবাজারের তুলনায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সের বিপরীতে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে, আর এই কারণেই হয়তো দেশে প্রবাসীদের আয় এলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের হিসাবে যোগ হচ্ছে না।
অর্থাৎ তার মতে, ব্যাংকিংব্যবস্থায় প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিনিময় হার কম থাকার কারণে হয়তো বিদেশে বসবাসরত কর্মীরা দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিংব্যবস্থা ব্যবহার না করে হুন্ডি বা বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করছেন।
গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিনিময় মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার পর হঠাৎ করে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর প্রবাসীদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সবশেষ ২ অক্টোবর ডলার লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ২০ পয়সা হারে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে ১০৭ টাকা। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বাজার বা কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বহুল ব্যবহৃত মার্কিন এই মুদ্রা বিক্রি হচ্ছে এর চেয়ে বেশি দামে।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান মনে করেন, রেমিট্যান্স আয় এবং রফতানি খাতে উপার্জন নিয়ে উদ্বেগ এবং শঙ্কা বাড়তেই থাকবে যদি না এই দুটো ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। তিনি বলেন, 'আপনাদের হয়তো মনে আছে, এই অর্থবছরের শুরুর দিকে আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপ পড়েছিল। সেটার একটা কারণ ছিল, রেমিট্যান্স আয় কমার ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ফরেন কারেন্সির সরবরাহ কমে যাওয়া। যেহেতু আমাদের অর্থনীতির দুটো বড় চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স এবং রফতানি খাত- তার যে গতিপ্রকৃতি, তাতে বলা যায় আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি বড় সংকট চলছে। সেই সংকট উত্তরণে এই দুটির সহায়ক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ফলে অবশ্যই উদ্বেগের জায়গা আছে।
এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ফরেন রিজার্ভে আমাদের স্বস্তির জায়গা আরও কমতে থাকবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন রিজার্ভে চাপ পড়বে অপরদিকে টাকার মান কমবে। এটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রোডাক্ট ডাইভারসিফাই করে রফতানি আয় বাড়াতে হবে। বিপরীত দিকে প্রকৃত পক্ষে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, অর্থপাচার যাতে না হয় এবং হুন্ডির মাধ্যমে যাতে রেমিট্যান্স না আসে সেগুলো মনিটরিং করতে হবে। তাতে রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় ফেরার সম্ভাবনা আছে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের মতে, রেমিট্যান্স আয় সেপ্টেম্বর মাসে তুলনামূলকভাবে কম হলেও সেটা নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ নেই। তিনি বলেছেন, গত মাসে রেমিট্যান্স কিছুটা কম হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন সময় এটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসবেরে সময় রেমিট্যান্স আয় বেশি হয়। জুলাই-আগস্ট মাসেই দুই বিলিয়ন করে রেমিট্যান্স এসেছে।'
বিইউ/জেবি