images

অর্থনীতি

খেলাপি ঋণে রেকর্ড, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতিও

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৭ পিএম

দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সংকট চলতি বছরে আরও গভীর হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এটি এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্বল তদারকির কারণে ব্যাংক খাতের প্রকৃত ঝুঁকি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে না।

গত দেড় দশকে আগের সরকারের আমলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর চেষ্টা করা হলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাস্তব চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। জুনে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার কোটির কিছু বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে দেশে মোট বিতরণকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা অনাদায়ী বা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শুধু এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক বছর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।

picture
প্রতীকী ছবি।

খেলাপি বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের গণনার নীতিমালা পরিবর্তন করায় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এছাড়া সরকার পরিবর্তনের কারণে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়েছে। আমরা খেলাপি কমানোর জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর থেকে সেটার প্রভাব দেখা যাবে।

তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জুন প্রান্তিকে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৩৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন করে কঠোর নজরদারি শুরু হওয়ায় দীর্ঘদিন কাগজে ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানো বহু ঋণ এখন মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফলে আগের সরকারের সময় বিতরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগুলোর প্রকৃত অবস্থা সামনে আসছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এখনও সবচেয়ে বেশি খেলাপির বোঝা বহন করছে—যেখানে ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশই অনাদায়ী।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি ঋণে সরাসরি চাপ পড়েছে প্রভিশন তথা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে। রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও শরিয়াহ খাতের ২৬টি ব্যাংকই প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পুরো ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায়, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘাটতি।

picture
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২৬টি ব্যাংক নিয়মানুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। যদিও কয়েকটি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ব্যাংক খাতে মোট ঘাটতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকায়। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে এই ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ২৬টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি, বেসরকারি ২০টি ও বিশেষায়িত একটি ব্যাংক। এই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে। বেসরকারি ২০টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ৭৮ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের ঘাটতি ২৫৯ কোটি টাকা। তবে বিদেশি খাতের ৯টি ব্যাংকে কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই।

টিএই/এআর