মহিউদ্দিন রাব্বানি
২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯ পিএম
• উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার সংকট
• ইনকামের জায়গাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি
• স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফল
• কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন
• সামাজিক সুরক্ষা জোরদারের তাগিদ ক্যাবের
• সমন্বিত নীতিগত সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই, মত অর্থনীতিবিদদের
দোকানের তাক থেকে শুরু করে রান্নাঘরের বাজার—সবখানেই বাড়তি দামের চাপ। নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি যেন এখনো অধরাই। চালের দামে কিছুটা কমতি এলেও মাছ, মাংস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের বাইরে গিয়ে কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ প্রকাশিত সর্বশেষ ইকোনমিক আপডেট অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। একই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং অখাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। সংখ্যার হিসাবে এ বৃদ্ধি সামান্য মনে হলেও বাস্তব জীবনে এর প্রভাব ব্যাপক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চালের দামে কিছুটা স্বস্তি এলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব খুব একটা অনুভূত হচ্ছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান এখনো বড় হলেও মাছ, মাংস ও অন্যান্য প্রোটিনজাত খাদ্যের দাম বাড়ায় সামগ্রিক ব্যয়ের চাপ কমছে না।
মূল্যস্ফীতির এই চাপ সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। মজুরি কিছুটা বাড়লেও তা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। নভেম্বরে মজুরি মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেবল বাজার তদারকি বা সাময়িক আমদানি বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। মূল্যস্ফীতি এখন একটি কাঠামোগত সমস্যায় রূপ নিয়েছে।
তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির প্রবৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ তাদের। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি বিশেষ বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন মূল্যস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায়, তখন মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।
রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ধীরগতির বাস্তবায়নও অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের গতি প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়ছে না, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত বাজারদরেও পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হলে দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত নীতিগত সংস্কারের বিকল্প নেই। উৎপাদন বাড়ানো, সরবরাহ ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, রাজস্ব কাঠামো শক্তিশালী করা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের ভাষায়, চালের দাম কমলেও সাধারণ মানুষের খাদ্য ব্যয়ের বড় অংশ এখন প্রোটিনজাত পণ্যে চলে যাচ্ছে। ফলে কয়েকটি পণ্যের দাম কমেছে বাস্তবে তেমন কাজে আসছে না।
মূল্যস্ফীতর লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে জনগণের ওপর একটা চাপ তো পড়েই। তবে এটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি কষ্টের। উচ্চবৃত্ত যারা আছে তাদের তো কোন সমস্যা নেই। তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যেসব কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে কত দেরি করা দরকার।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি মূল্য এবং আর্থিক খাত—সব জায়গায় সমন্বিত সংস্কার দরকার। একক কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে এই চাপ কমানো যাবে না।
এমআর/ক.ম