images

অর্থনীতি

‘উদ্বেগজনক’ মাত্রায় প্রভিশন ঘাটতি, ঝুঁকিতে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৩০ পিএম

দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণও অনেক ব্যাংকেই অনিয়মিত। সরকারি, বেসরকারি ও শরিয়াহ খাতের ২৬টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংকে ঘাটতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক, একীভূত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের মতো বড় ব্যাংকগুলোর ঘাটতি শতাধিক হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। শুধু ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতি প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে দুর্বলতা এবং বড় ঋণগ্রহীতাদের প্রতি অতিরিক্ত ছাড় প্রভিশন ঘাটতির মূল কারণ। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৬টি ব্যাংক নিয়মানুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতি প্রায় ৩ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। কয়েকটি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকায় ব্যাংক খাতের মোট ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায়। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেশি, সেগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ব্যাংকের জন্য একসঙ্গে আমানতের সুদ পরিশোধ, পরিচালন ব্যয় মেটানো এবং প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ-এই তিনটি ভার বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ও শরিয়াহ ব্যাংকে ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেই অনুপাতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়নি। বরং নানা হিসাবনিকাশ, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের সুযোগ নিয়ে অনেক ব্যাংক দায় এড়িয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ২৬টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি, বেসরকারি ২০টি ও বিশেষায়িত একটি ব্যাংক। এই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে। বেসরকারি ২০টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ৭৮ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের ঘাটতি ২৫৯ কোটি টাকা। তবে বিদেশি খাতের ৯টি ব্যাংকে কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিক প্রতিবেদন স্বচ্ছ না হলে এবং প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ না করলে ব্যাংকের প্রকৃত ঝুঁকি মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। এ কারণে আগামীতে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি বা আরবিএস (Risk Based Supervision) আরো জোরদার করা হবে।

bangladesh-bankসেপ্টেম্বর প্রান্তিকে যেসব ১০ টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই রয়েছে শরিয়াহ ও বেসরকারি খাতে। তালিকায় এস আলম গ্রুপের লুটপাটের শিকার অন্তত পাঁচটি ব্যাংকও আছে। এ সময়ে সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮২ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি একীভূত হওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের-৫২ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, যার প্রভিশন ঘাটতি ৪৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা।

এ ছাড়া একীভূত হওয়া এক্সিম ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৩ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১৫ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৮ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ২৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের ১৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১০ হাজার ৪৮ কোটি টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ১৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।

এছাড়াও প্রভিশন ঘাটতিতে আছে বেসিক ব্যাংক (৫ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা), ইউসিবি ব্যাংক (৪ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা), স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক (২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা), মার্কেন্টাইল ব্যাংক (১ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা), এনআরবিসি ব্যাংক (১ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা), এবি ব্যাংক (১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা), সাউথইস্ট ব্যাংক (১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা), ঢাকা ব্যাংক (৬৩৬ কোটি টাকা), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক (৬১৫ কোটি টাকা), এনআরবি ব্যাংক (২৭০ কোটি টাকা), প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (২৩৯ কোটি টাকা), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (৪০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা), আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক (৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা) ও এনসিসি ব্যাংক (৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা)।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রভিশন ঘাটতির পেছনে মূল কারণ হলো খেলাপি ঋণ আদায়ে দুর্বলতা, বড় ঋণগ্রহীতাদের প্রতি অতিরিক্ত ছাড় এবং নিয়মিত পুনঃতফসিলের সংস্কৃতি। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত আমানতকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন হবে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপকে নামে-বেনামে বড় ঋণ দেওয়া হয়েছিল এবং খেলাপি ঋণ কাগজে কম দেখাতে নেওয়া হয় নানা নীতিগত সিদ্ধান্ত। সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই নীতি ছেড়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণের নীতিমালা কঠোর করে। এর ফলে শেষ কয়েক প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর আগের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ১১ কোটি টাকা এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেড়েছে আরও ৩৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা।

টিএই/এমআর