মহিউদ্দিন রাব্বানি
০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৪ পিএম
# বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় থমকে আছে
# নীতির ধারাবাহিকতা না থাকায় দ্বিধায় ব্যবসায়ীরা
# শ্রমবাজার সংকোচন ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলেছে
# নির্বাচিত সরকারই আস্থা ফিরিয়ে আনবে: প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের
দীর্ঘায়িত রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়ায় অনেকটা থমকে আছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি, আর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন-কবে ফিরবে স্থিতিশীলতা, কবে স্বাভাবিক নীতির ধারাবাহিকতা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও স্পষ্ট ও স্থিতিশীল পরিবেশ না ফিরলে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিবেশ বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তাই এখন ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহর গুনছেন।
বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় থমকে গেছে
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, চলমান অনিশ্চয়তার কারণে বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে। প্রাথমিক সমঝোতা সম্পন্ন কিছু বিনিয়োগও পিছিয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) এক পরিচালক বলেন, ‘যেখানে প্রতিদিনই রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে কে? বিদেশিরা সরাসরি প্রশ্ন করে-আপনারা কি আগামী পাঁচ বছর একই নীতি বজায় রাখতে পারবেন?’
নীতির ধারাবাহিকতা না থাকায় দ্বিধায় ব্যবসায়ীরা
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু নীতি ও নির্দেশনা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এতে ব্যবসা পরিকল্পনায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। আমদানি-রফতানি, ট্যাক্স, ভর্তুকি, শ্রমনীতি-সবকিছুতেই দেখা দিতে পারে পরিবর্তন।
তারা বলেন, গার্মেন্টস খাত প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপের মুখে থাকে। এখন তারা রাজনৈতিক স্থিতি চান। অর্ডার ধরে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন পরিকল্পনা করতে গেলে জানতে হয়- আগামী ছয় মাসে দেশের পরিস্থিতি কেমন থাকবে।
শ্রমবাজারে ঘোর অমানিশা
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শ্রমবাজারে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সিন্ডিকেট ও জটিল নিয়মাবলীর কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের শ্রমবাজার স্থবির হয়ে গেছে।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা ফরিদ আহমেদ মুন্না ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে শ্রমবাজার স্থবির হয়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে মালয়েশিয়া নিয়ে ঝামেলা চলছে। আগে ১০০ এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানো হলেও এখন ২৫টি এজেন্সি সিন্ডিকেটে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বিগত সময়েও জটিলতা ছিল তা নিরসনেও সফলতার মুখ দেখছে না সরকার।’
ফরিদ আহমেদ আরও বলেন, ‘দুবাইয়ে শ্রমিক ভিসা বন্ধ। এটা বাংলাদেশের বড় একটা বাজার ছিল। দুই-তিনটি এজেন্সির মাধ্যমে সীমিত লোক যাচ্ছে। কাতারেও এই অবস্থা। কুয়েতেও শ্রমবাজারে সীমিত প্রবেশ। ওমান আর বাহরাইন বন্ধ। সৌদিতে আগে প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ লোক যেত। কয়দিন পরপর নিয়ম পরিবর্তন করায় বিড়ম্বনায় এখন যাত্রীরা। ফলে ঘুষ বাণিজ্যে দিকে ঝুঁকছে অনেকে।’
তিনি আরও জানান, ‘অনিশ্চয়তার কারণে বন্ধ করা কোন দেশের শ্রমবাজার চালু করা যায়নি। বাংলাদেশে সম্প্রতি জটিল জটিল নিয়ম করায় মানুষ বাংলাদেশ থেকে না গিয়ে ভারত নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যাচ্ছে। একটি সিন্ডিকেট বাজার ধ্বংস করার চেষ্টায় জড়িত।
‘ইউরোপের কোনো দেশে কাজের ভিসা চালু করতে পারেনি। বিগত সময়ে ক্রোয়েশিয়ায় বন্ধ হওয়া শ্রমবাজার চালু করতে পারেনি। শ্রমিক বান্ধব কাজ না করে না। মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশ এখন এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে। এটি আমাদের জন্য সুখকর নয়।’
শ্রমবাজার সংকোচন ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলেছে
মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে শ্রমবাজার স্থবির হয়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেমিট্যান্স কমলে ভোক্তা ব্যয় কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে স্থানীয় শিল্পে।
এক্সপোর্ট ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এক্সিমএবি) একজন সাবেক সভাপতি বলেন, ‘শ্রমবাজার যেমন বসে গেছে, তেমনি আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোও খালি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশিরা বলছে- আগে রাজনীতি ঠিক হোক, তারপর তারা আসবে।’
দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই
ব্যবসায়ীরা জানান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসা চলে না। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দ্রুত হলে নীতির স্থিরতা ফিরে আসবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) একজন পরিচালক বলেন, ‘বিনিয়োগ পরিকল্পনা কাগজে পড়ে আছে। ব্যাংকগুলোও ঝুঁকি নিতে চাইছে না। উদ্যোক্তারাও নতুন কারখানা চালু করতে ভয় পাচ্ছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত নির্বাচন হবে, দেশের জন্য তত ভালো।’
নির্বাচিত সরকারই ফিরিয়ে আনবে আস্থা
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রধানত রাজনৈতিক স্থিতির ওপর নির্ভরশীল। আগের অভিজ্ঞতাও বলে- যখন রাজনৈতিক ঝুঁকি কমে, তখন বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন মাঠপর্যায়ে তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র প্রস্তুতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শুধু তারিখ নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও স্থিতিশীল পরিবেশই এখন সবচেয়ে জরুরি।
অর্থনীতিবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা রিস্ক ক্যালকুলেট করে সিদ্ধান্ত নেয়। আর রাজনৈতিক রিস্ক এখনই সবচেয়ে বড়। এই রিস্ক কাটাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন।’
ব্যবসায়ী মহলে এখন একটাই চাওয়া রাজনৈতিক স্থিতি ও নীতির ধারাবাহিকতা ফিরে আসুক। দ্রুত নির্বাচন হয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা গেলে দেশের অর্থনীতিতে আবার গতি ফিরবে।
বর্তমানের জাপানের টোকিওতে বাণিজ্যিক সফরে থাকা নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বুধবার এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের নিয়ে মিটিং হয়। সেখানে অনেকেই আমাদের দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ না থাকায় বিনিয়োগ করতে চান না। তারা আমাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, ‘দেশে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য এক অনিশ্চিত ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতি। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশে শিল্প-উৎপাদন এবং আমদানি-রফতানি খাত। নির্বাচন পেঁছানোর গুঞ্জনও রয়েছে। এমনটা হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও উদ্বেগ বেড়ে যাবে।’
এক প্রশ্নের জাবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সরকার যদি বলে আগামী তিন বছর কিংবা পাঁচ বছর পর নির্বাচন হবে তাহলে ব্যবসায়ীরা সেভাবে টার্গেট করবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম থাকতে হবে। এখন এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অনেক কিছুতে অনিশ্চতা দেখা দিয়েছে। তবে সরকারের ঘোষিত আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার গঠন হলে যদি স্থিতিশীল পরিবেশ হয় আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। আমরা চাই যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন হোক। রাজনৈতিক টানাপোড়ন আর অস্থিরতা থেকে ব্যবসা খাত রক্ষা পাক।’
এমআর/এমআর