images

অর্থনীতি

'খেলাপি ঋণে উৎপাদনমুখী খাতে ঋণপ্রবাহ আরও সংকুচিত হবে'

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৩ পিএম

দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার ফলে উৎপাদনমুখী খাতে ঋণপ্রবাহ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)-এর সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সামগ্রিক ঋণব্যয় বাড়াবে এবং উৎপাদনমুখী খাতে অর্থপ্রবাহ আরও সংকুচিত করবে।

বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) বনানীর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) কার্যালয়ে মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন। সেপ্টেম্বর–অক্টোবর সময়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে পিআরআই। এ সময় তিনি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে “রক্তক্ষরণ”-এর সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, ব্যবসায়ী সমাজের সংকট, উদ্বেগ বা চিৎকার—কিছুই সরকার শুনছে না।

বিসিআই সভাপতি জানান, ২০২২ সালের পর থেকে জ্বালানি সরবরাহ সংকট আরও গভীর হয়েছে। সরকার দাম বাড়ালেও বাজারে পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ক্ষুদ্র উদ্যোগীদের বড় একটি অংশ ব্যবসা গুটিয়ে রাজধানীতে এসে অটোরিকশা চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। তার ভাষায়, প্রায় অর্ধেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, যা সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকেই বিপন্ন করে তুলছে।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, যখন খেলাপি ঋণ ১৭ শতাংশ ছিল, তখন আইএমএফ বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ’ বলেছিল। এখন খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ কোন পর্যায়ে পড়বে—সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

অনুষ্ঠানে পিআরআইয়ের সেন্টার ফর ম্যাক্রোইকোনমিক অ্যানালাইসিস (সিএমইএ) সেপ্টেম্বর–অক্টোবর সংস্করণের এমএমআই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়ায় সামান্য স্থিতিশীলতার আভাস মিললেও সামগ্রিক পুনরুদ্ধার এখনও অত্যন্ত নাজুক। অনাদায়ী ঋণ বর্তমানে ৬.৪ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই এনপিএল পরিস্থিতিকে ‘বিষাক্ত চাপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা পুরো আর্থিক খাতকেই ঝুঁকিতে ফেলছে।

পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, অর্থনীতির সামগ্রিক গতি মন্থর হলেও স্বল্পমাত্রায় স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে কর্মসংস্থান বাড়াতে উদার মনোভাবাপন্ন নীতি প্রয়োজন। রপ্তানিতে পাল্টা শুল্কের চাপ থাকলেও বাংলাদেশ এখনও প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে বলে তিনি মনে করেন।

পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, এনপিএল–সংকট এখন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সমন্বিত সমাধান কাঠামো প্রয়োজন। তার মতে, ৬.৪ ট্রিলিয়ন টাকার অনাদায়ী ঋণের বোঝা নিয়ে কোনো ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল থাকতে পারে না। উচ্চ সুদহার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভরতা এবং উৎপাদন খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেশ এখন ‘উচ্চ সুদ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও নিম্ন বিনিয়োগের’ দুষ্টচক্রে আটকে যাচ্ছে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা করনীতি সংস্কার, রপ্তানি বৈচিত্র্য, দক্ষতা উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন। তাদের মতে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে না আনলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা সম্ভব হবে না, এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

টিএই/ক.ম