images

অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বাজারভিত্তিক’ ডলার দর পদ্ধতি নিয়ে আইএমএফের অসন্তোষ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০১ এএম

# তৃতীয় দিনের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক-আইএমএফের বৈঠক

# রেফারেন্স রেটের মাধ্যমে দর নির্ধারণে আইএমএফের আপত্তি

# দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বন্ধকি সম্পত্তি আবশ্যক দাবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বাজারভিত্তিক’ ডলার দর নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে রেফারেন্স রেটের ওপর নির্ভর করে ডলার দর ঠিক করছে, তা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক নয়। প্রকৃত অর্থে ডলার দর বাজারভিত্তিক করতে হলে তা সম্পূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

এ নিয়ে রোববার (২ নভেম্বর) টানা তৃতীয় দিনের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধিদের বিস্তারিত আলোচনা হয়।

আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরী, ড. কবির আহমেদ, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক (গ্রেড-১) ড. এজাজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, ডলারের বাজারের বিষয়ে গভর্নরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা রেফারেন্স রেটের মাধ্যমে বাজারভিত্তিক ডলার দর নির্ধারণ করেছি।’ তবে আইএমএফ স্পষ্ট করে বলে, রেফারেন্স রেট কখনও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক দর হিসেবে গণ্য হতে পারে না। বাজারভিত্তিক ডলার দর করতে হলে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

রেফারেন্স রেট হলো একটি মানদণ্ড, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করে এবং ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেনে ব্যবহৃত হয়। এটি বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অংশগ্রহণকারীদের জন্য একটি ভিত্তিমূল্য হিসেবে কাজ করে এবং কোম্পানি, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি দিনের জন্য একটি নির্দেশমূলক বিনিময় হার প্রদান করে এবং কখনও কখনও ডলারের কেনা-বেচার ব্যবধান নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

বৈঠক সূত্র জানায়, রোববারের বৈঠকেও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তার বিষয়টি আলোচনা হয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কোনো প্রকার কো-লেটার বা বন্ধকি সম্পত্তি ছাড়া ঋণ দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলে। ঋণ প্রদোনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ।

এর আগে গত বুধবারের বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ব্যাংক লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় ধার দেওয়া বিষয়েও আলোচনা হয়। এখন পর্যন্ত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় জামানত ছাড়া প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে সুবিধা দেওয়ার ঘটনা বিরল। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিল বা বন্ড জমা রাখতে হয়। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দিতে পারে না। কিন্তু এসব ব্যাংকের কাছে ব্যবহারযোগ্য বিল-বন্ড না থাকায় তারা প্রতিশ্রুতিপত্র (ডিমান্ড প্রমিসরি নোট) প্রদান করে টাকা ধার নিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিপত্রের মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক মেয়াদ শেষ হলেও টাকা ফেরত দিতে পারেনি।

এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ জানিয়েছে, আনসিকিউরড বা জামানতহীন ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিতে পারবে না। এই প্রথা এখনই বন্ধ করতে হবে, কারণ এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো উত্তর দেয়নি।

এছাড়াও গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের বৈঠকে পতিত সরকারের সময় গোপন করে রাখা বিপুল খেলাপির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। তবে রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠনসহ বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন এবং প্রাক-অর্থায়ন সুবিধা নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।

dollarসূত্র জানায়, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। যদিও গত বছরের আগস্টে সরকারের পালাবদলের পর গোপন করে রাখা খেলাপি প্রকাশ হতে থাকে। গত জুন শেষে লক্ষ্য করা গেছে, মাত্র এক বছরে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা খেলাপি বেড়ে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, আর বেসরকারি খাতেও খেলাপি ১০ শতাংশ পেরিয়েছে।

বৈঠক সূত্র আরও জানায়, আইএমএফ মুদ্রানীতির কাঠামো বিষয়ে বিস্তৃত তথ্য নিয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতি কমায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে, তবে সংকোচনমূলক নীতির কারণে যেন বিনিয়োগ দীর্ঘ সময় বাধাগ্রস্ত না হয়—সেজন্য সুনির্দিষ্ট পন্থা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে তারা পরবর্তী ১২ মাসের সামষ্টিক অর্থনীতির রূপরেখা সম্পর্কেও তথ্য নিয়েছে।

এছাড়া খেলাপি ঋণসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক চিত্র, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, ব্যাংকগুলোকে দেওয়া পুনর্মূলধন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের চিত্র এবং ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ও তা কমানোর পদক্ষেপ বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। এছাড়া জলবায়ু, টেকসই বিনিয়োগ এবং সবুজ অর্থনীতিতে কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

তিন দিনের এই বৈঠকে আমানত উত্তোলনে সীমা, আগে আরোপিত আমানত উত্তোলন সীমা ও তার প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে তারল্য সংকটের মূল উৎস, আমানত ঘনত্ব, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনামূলক পদক্ষেপ, ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ, পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ও ঝুঁকি পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা হয়।

আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সাল থেকে কয়েক দফা আলোচনার পর ২০২৩ সালের শুরুর দিকে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। সবশেষ গত জুনে অর্থ ছাড়ের সময় ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ঋণ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে বছর ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায়। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া যায় দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার আসে ২০২৪ সালের জুনে। আর চলতি বছরের জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে মিলিয়ে ১৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ।

তবে ষষ্ঠ কিস্তি পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই কিস্তি ছাড়ের নির্ধারিত সময় আগামী ডিসেম্বর। কিন্তু সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় এই সময়ের মধ্যে অর্থ ছাড় নাও হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ঋণের শর্ত অনুযায়ী যেসব সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো নির্বাচিত সরকারের সময়ও অব্যাহত থাকবে কি না, তা নিশ্চিত হতে চাইছে আইএমএফ।

ডিসেম্বরের বদলে আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলে পরবর্তী কিস্তি ছাড় হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে ষষ্ঠ কিস্তি না ছাড়লে পরে সপ্তমসহ দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে বিনিময় হার ইস্যুতে সমঝোতায় দেরি হওয়ায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পেয়েছিল বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, ‘আইএমএফের পঞ্চম রিভিউ মিশন নিয়মিত সফরে রয়েছে। মিশনটি তাদের ঋণের শর্তের অগ্রগতি জানতে তথ্য নিচ্ছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপ, সুদের হার, তারল্য সহায়তা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণ কমাতে গৃহীত পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছে।’

টিএই/এমআর