images

অর্থনীতি

গতি ফিরছে অর্থনীতিতে, ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছে প্রধান খাতগুলো

মহিউদ্দিন রাব্বানি

১৪ আগস্ট ২০২৫, ০৭:০৭ এএম

নানা চ্যালেঞ্জ ও অস্থিরতা পেরিয়ে ধীরে ধীরে গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতিতে। বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের সীমাহীন লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা অনেকটা কাটিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ভঙ্গুর অর্থনীতিতে এবার গতি আসতে শুরু করেছে। ইতিবাচক সংকেত পাওয়া যাচ্ছে প্রধান খাতগুলোতে।   

বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশন ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, শিল্প উৎপাদন, রফতানি আয়, কৃষি উৎপাদন এবং প্রবাসী আয়ে দৃশ্যমান উন্নতি হচ্ছে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশ আগের তুলনায় অনেকটাই স্থিতিশীল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখা এবং ব্যবসা সহজীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা জরুরি। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।

প্রবাসী আয়ে রেকর্ড
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর পদক্ষেপে অবৈধ হুন্ডি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া প্রবাসীদের মধ্যেও ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। সরকারের উদারনীতি ও প্রণোদনার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এই প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। রফতানি ও প্রবাসী আয় শক্তিশালী রিজার্ভ পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

গতকাল মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার একটি অনুষ্ঠানে বলেন, স্বৈরশাসনের সময় টাকা চুরি করে ব্যাংক খালি করা হয়েছিল। পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে অর্থনীতি মজবুত অবস্থায় ফিরে এসেছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যালান্স অব পেমেন্টসে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং পাশাপাশি টাকা-ডলারের বিনিময় হারও স্থিতিশীল রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব বিবেচনায় বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করেছি, যদিও এটি অন্যদেরও (আইএমএফের) পরামর্শ ছিল। অনেকের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বিনিময় হার মোটেও অস্থির হয়নি। টাকার ওপর মানুষের আস্থা এখন বাড়ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল
২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ তিন বছরের মাথায় ২০২৪ সালে নেমে আসে অর্ধেকে। আওয়ামী সরকারের পতনের সময় এই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে বছরান্তে তা বেড়ে ২৫ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৩০ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের মাথায় রিজার্ভে এমন উন্নতিকে সরকারের বিশাল অর্জন হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। 

ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরেছে
ব্যাংকে ডলারের দাম কমলেও খোলাবাজারে এর দামে তেমন কোনো ওঠানামা নেই। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দর ১২১ দশমিক ৩৫ থেকে ১২১ দশমিক ৯০ টাকার মধ্যে সীমিত। ফলে ব্যবসায়ীদের ডলার নিয়ে ঝামেলা অনেকাংশই কমে গেছে দাবি সংশ্লিষ্টদের। 

রফতানি খাতে আশাব্যঞ্জক সাফল্য
ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এতে রফতানি খাতে আশাব্যঞ্জক সাফল্য এসেছে। গত জুলাইয়ে দেশের রফতানি বেড়ে হয়েছে চার দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের তিন দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। 

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এ তথ্য জানিয়ে বলছে, ২০২২ সালের নভেম্বরের পর এই প্রথম মাসভিত্তিক রফতানি আয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, প্রকৌশল পণ্য ও তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়ে যাওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। হিমায়িত মাছ, শাক-সবজি ও তামাক রফতানি বেড়েছে। কমেছে চা ও কাচের পাত্র রফতানি। 

শুধু পোশাক নয়, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও আইসিটি খাতেও রফতানি আয় বাড়ছে। আইসিটি রফতানিতে গত বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এসেছে, যা মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ফ্রিল্যান্সিং ও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেবার কারণে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে উদ্যোগ গ্রহণ
অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর এক সংকেত হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। গত তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের আশেপাশে থাকা মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কিছুটা শিথিল হতে শুরু করে। গত বছর আগস্টে যেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০২৫ সালের জুনে তা কমে এসেছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে গেল মাস জুলাইয়ে হঠাৎ করে এই গতি উল্টো দিকে মোড় নেয়- যা আবার বাড়ার সংকেত দিয়ে মূল্য স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা জিইয়ে রেখেছে। 

এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল জুন-জুলাইয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। তবে আগের থেকে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। যদিও আমরা সন্তুষ্ট নই।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে মুদ্রাস্ফীতি ৬-৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা জরুরি। এর জন্য বাজার নজরদারি, মজুদ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহন ব্যয় হ্রাসের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে সদ্য প্রকাশিত পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) জুলাইয়ে বাংলাদেশের পিএমআই সূচক দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৫ পয়েন্ট, যা আগের মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেশি। ৫০-এর ওপরের এ স্কোর অর্থনীতির সম্প্রসারণ বা প্রবৃদ্ধির স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সূচক শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়- বরং এটি শিল্প, সেবা এবং নির্মাণ খাতে পুনরুজ্জীবনের একটি নিঃসন্দেহ বার্তা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থা থেকে আমরা স্বস্তির দিকে এগোচ্ছি- এটা ঠিক। কিন্তু এখনো আমাদের অবস্থা ভালো বলা যাবে না। অস্বস্তির জায়গা থেকে কিছুটা সরে আসতে পেরেছি।’

বিনিয়োগ খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে দাবি করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিতে চান না। স্থিতিশীল সরকার এলে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে।’

তার মতে, এছাড়া বাজেটে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যও বেশ কিছু উদ্যোগ রাখার সুযোগ ছিল, সরকার কোন উদ্যোাগ গ্রহণ করেনি। বাজেট মূলত গতানুগতিক হয়েছে। নতুন বাজেটে সরকার কালো টাকা সাদা করার বিধান কঠোর করে কিছুটা বহাল রাখলেও পরবর্তী সময়ে সমালোচনার মুখে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে, এটা ভালো দিক।

জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রিজার্ভ, রফতানি ও রেমিট্যান্সে যে ফলাফলটা দেখা গেছে- এতে সররকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও অবদান রয়েছে।’ 

সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজস্ব খাতের সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নে স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার আর্থিক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কোনোটিরই দৃশ্যমান ফলাফল নেই। তবে ব্যাংক খাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মালিকদের চিহ্নিত করা গেছে। কিছু পর্ষদ পরিবর্তনও হয়েছে। যদিও সংস্কার কার্যক্রম এখনো প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে রয়েছে।’

এদিকে গত এক বছরের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি আইসিইউ থেকে এইচডিইউতে পৌঁছেছে। আমরা খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছি। তবে অর্থনীতি এখনো নিরাপদ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়নি। স্বস্তি এসেছে অর্থনীতিতে, কিন্তু এখনো তৈরি হয়নি আত্মতুষ্টির জায়গা।’

দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারা থেকে আইসিইউ হয়ে এখন কেবিনে ফিরছে। এটি কবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখনো কেবিনে ফেরার মতো অবস্থায় নেই। আর গরিব দেশের অর্থনীতি কেবিনে ফিরবে না। পেয়িং বেড বা ওয়ার্ডে ফিরবে, তারপর বাড়ি ফিরবে।’

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে ব্যাংক খাতের লুটপাট করা হয়নি। একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আমি জানতে চাইলাম, সে বলছে স্যার ৯৫ শতাংশই খেলাপি। কে নিয়েছে টাকা? চেয়ারম্যান সাহেব, আর তার লোকজন। চিন্তা করতে পারেন। পৃথিবীর কোনো দেশে ব্যাংকের টাকা এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সেটা আপনার-আমার টাকা কিন্তু।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘আর্থিক খাতের বিশাল বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবে দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় বা আইসিইউতে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’

এমআর/জেবি