images

অর্থনীতি

পাল্টা শুল্ক: ঝুঁকি সামলে ‘উইন-উইন’ অবস্থানে বাংলাদেশ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

০১ আগস্ট ২০২৫, ১০:০৬ পিএম

  • স্বস্তির বার্তা, ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা
  • চাপে পড়ছে ভারত ও মিয়ানমারের পোশাক খাত
  • প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্রয়াদেশ আসতে পারে বাংলাদেশে
  • ৮ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে নতুন শুল্ক

বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক ১৫ শতাংশ কমে ২০ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এটাকে স্বস্তির বার্তা ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। অন্তর্বর্তী সরকারও এটাকে নিজেদের কূটনৈতিক সাফল্যের বড় দলিল হিসেবে উপস্থাপন করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের এই সাফল্যের স্বীকৃতি দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে রফতানিকারকদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি নানা কারণে এটাকে বাংলাদেশের জন্য ‘উইন-উইন’ অবস্থান হিসেবে দেখছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের তৃতীয় দফার আলোচনা শুরু হয় গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দফতরের সঙ্গে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এই আলোচনার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই)। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ইউএসটিআর'র সঙ্গে দর কষাকষির মাধ্যমে ৩৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। পরে হোয়াইট হাউস ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করে আদেশ জারি করে।

পাল্টা শুল্ক আগামী ৮ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সই করা নির্বাহী আদেশ অনুসারে, সইয়ের দিন বাদ দিয়ে সাত দিন পর থেকে এই শুল্কহার কার্যকর হচ্ছে বলে হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে। পূর্বাঞ্চলীয় সময় (ইস্টার্ন টাইম) অনুযায়ী, শুল্ক কার্যকরের সময় নির্ধারিত হয়েছে রাত ১২টা ১ মিনিট। সেই হিসাবে বাংলাদেশ সময় হবে সকাল ১০টা ১ মিনিট। এই সময়ের পর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানো কিংবা গুদাম থেকে ছাড় করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হবে।

আরও পড়ুন

সংকটে পোশাক খাত, বাড়ছে উদ্বেগ ও হতাশা

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারাটা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমাদের যে রফতানি ঝুঁকিটা ছিল, সেটা এখন মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমরা এখন বলতে গেলে ভালো অবস্থানে আছি।

Tarif3
দফায় দফায় বৈঠক করেছে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষির মাধ্যমে শুল্ক কমানোর ব্যাপারটা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কূটনৈতিক সফলতা। এতে বাণিজ্য খাতে যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকটাই কেটে যাবে। আমরা এখন 'উইন-উইন' সিচুয়েশনে আছি।

ভারত ও মিয়ানমারে পোশাক বাজারে ধস

বাংলাদেশের পণ্যে পারস্পরিক শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে ভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে দেশটি। যা আজ থেকে কার্যকর হয়েছে। এরপরই শুক্রবার (১ আগস্ট) ভারতের পোশাক বাজারের শেয়ারে দরপতন হয়েছে। একই ধরনের প্রভাব পড়েছে মিয়ানমারেও।

বাংলাদেশ আগে থেকেই তৈরি পোশাক (আরএমজি) রফতানির অন্যতম বড় দেশ। নতুন এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় ও মিয়ানমারের পোশাক প্রস্তুতকারকদের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ আসতে পারে বাংলাদেশে।

বাণিজ্য খাতে এই সফলতায় সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে দেশের ব্যবসায়ী, ব্যবসায়িক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের বেশির ভাগই এটিকে সফলতার মানদণ্ডে দেখতে চান।

আরও পড়ুন

বাণিজ্যে ‘ট্যারিফ ঝড়’, দিশাহারা ব্যবসায়ীরা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক বিজয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শুক্রবার (১ আগস্ট) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

Tarif2
ডোনাল্ড ট্রাম্পে আরোপি এই শুল্ক কার্যকর হবে ৮ আগস্ট থেকে। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের ট্যারিফ আলোচক দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়। শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারা- যা প্রত্যাশিত হারের চেয়ে ১৭ পয়েন্ট কম; এটি আমাদের আলোচক দলের অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা ও দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় অটুট প্রতিশ্রুতির একটি উজ্জ্বল প্রমাণ।

যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে দেওয়া অন্তবর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে পেরেছি। এটি আমাদের পোশাক খাত এবং লাখো শ্রমিকের জন্য ভালো খবর। পাশাপাশি, আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগও তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

কোন দেশের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ওপর সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের সংবাদকে ‘দেশের জন্য ভালো খবর’ অবিহিত করে এজন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, গত কয়েক দিন আগে আপনারা দেখেছেন যে, আমেরিকা আমাদের পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপ করেছে। ট্যারিফ কী জানেন? আমরা যেসব পণ্য রফতানি করব তার ওপর ৩৫ ভাগ ট্যাক্স নিয়ে নেবে। অর্থাৎ আমাদের যে জিনিসটার দাম ১০০ টাকা ওটার সঙ্গে আরও ৩৫ টাকা যোগ হবে… তার মানে ১০০ টাকার জিনিস ১৩৫ টাকা দাম হবে। ফলে আমাদের জিনিসটা আর বিক্রি হবে না।

Tarif5
বেশি শঙ্কা ছিল পোশাক খাত নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত

২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

তিনি তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘১৫ শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ২০ শতাংশ। অ্যানাদার সাকসেস অফ ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট’।

শুল্ক কমানোর এমন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু।

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এখন শুল্কহার প্রায় সমান বা কোথাও কোথাও কিছুটা কম। এটি আমাদের জন্য স্বস্তির বার্তা। আমরা ধীরে ধীরে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো।’

নতুন শুল্কহার যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের এখন প্রায় ২০ শতাংশ বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে, যার প্রভাব পড়তে পারে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও স্থানীয় বাজারে ভোগ ব্যয়ে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে আমাদের রফতানি অর্ডারে কিছুটা ধাক্কা লাগতে পারে এবং পণ্যের দামে চাপ তৈরি হতে পারে।’

আরও পড়ুন

২০ শতাংশ শুল্ক অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি সফলতা: আসিফ নজরুল

বিকিএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা মেইলকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘প্রথমত আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ও তার টিমকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের কূটনীতিক সফলতা। এখন আমরা 'উইন-উইন' অবস্থানে আছি।’

Tarif4
শুল্ক কমানো সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘আমরা এখন ভিয়েতনাম বা ভারতের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছি। শুল্কহার ২৫ শতাংশে গেলে আমাদের রফতানি সক্ষমতা আরও সংকটে পড়ত।’

তবে এখানেই থেমে গেলে চলবে না বলে মনে করেন মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এখন থেকে চিন্তা করা, কীভাবে এই শুল্ক হার আরও সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। সরকারকে ভবিষ্যতের রফতানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমানো কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান উপদেষ্টা

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়া নিঃসন্দেহে ভালো দিক। তবে ২০ শতাংশও আমাদের জন্য এখনো বেশি। ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, আমরা আর আগের মতো ঝুঁকির মধ্যে নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় এখন আমাদের কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে।’

এমআর/জেবি