images

অর্থনীতি

'ইলিশ দেখতেই ভালো লাগে, দাম শুনে আর কিনতে মন চায় না'

মহিউদ্দিন রাব্বানি

০১ আগস্ট ২০২৫, ০৬:০৬ পিএম

ইলিশকে বলা হয় দেশি মাছের রাজা। এখন ইলিশের ভর মৌসুম। কিন্তু এই সময়েও বাজারে সুস্বাদু এই মাছটি বিক্রি হচ্ছে সোনার দামে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে ইলিশের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক কেজির উপরের একটি ইলিশ কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২৮০০ টাকা পর্যন্ত। ছোট ইলিশের দামও ১০০০ টাকার নিচে নামছে না। যার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ তো দূরের কথা, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও এখন ইলিশের স্বাদ নিতে সাহস পাচ্ছে না।

শুক্রবার (১ আগস্ট) রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদা থাকলেও সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বাড়ছেই। পাশাপাশি ট্রান্সপোর্ট খরচ, হিমায়িত সংরক্ষণের ঝুঁকি এবং রফতানি সম্ভাবনার কারণে বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা কম। ফলে সাধারণ ভোক্তারা ইলিশের ন্যায্যমূল্যে কেনার সুযোগ হারাচ্ছেন।

যাত্রাবাড়ী মৎস আড়তে এক বিক্রেতা বলেন, ‘ইলিশের দাম বেশি। বেচাকেনা কম। আগে দিনে ১৫-২০ কেজি ইলিশ বিক্রি হতো, এখন ৫-৭ কেজিও বিক্রি হচ্ছে না।’

অপর বিক্রেতা বলেন, ‘মানুষের তো অভাব নেই। সবাই দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। মাছ কিনছে না। মাঝে মাঝে স্যারেরা বেশি করে মাছ নিয়ে যায়৷ গরিবরা দামের কারণে নিতে পারে না।’

আরও পড়ুন

ইলিশ এখন গরিব-মধ্যবিত্তের অতীত স্মৃতি!

অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে ঢুকেই ইলিশের দাম শুনে পিছু হটতে হয়। রিকশা শ্রমিক মুরাদ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ইলিশের দাম শুনলে কপালে ঘাম ধরে যায়। ইলিশ দেখতেই ভালো লাগে, দাম শুনে আর কিনতে মন চায় না।’

HH

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় চাষযোগ্য দেশি মাছের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে সামনের বছরগুলোতে সাধারণ মানুষ ইলিশ শুধু গল্পেই শুনবে।

আরও পড়ুন

ইলিশ চেয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দিল কলকাতার ব্যবসায়ীরা

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ শুধু উৎসবের নয়, বাঙালির আবেগের প্রতীক। তাই এই মাছের বাজারে নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায্য দামে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। নয়তো ‘ইলিশ তো সবার’ স্লোগানটি শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।

মৌসুমেও আকাশছোঁয়া দাম

সাধারণত বর্ষা মৌসুমে বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়ে, দাম কমে এবং সাধারণ মানুষও এই মাছের স্বাদ নিতে পারে। কিন্তু চলতি বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাদ্র মাসের আগেই বাজারে ইলিশের আমদানি কিছুটা বাড়লেও দাম কমার বদলে উল্টো বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে কম, আবার যা ধরা পড়ছে, তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে রফতানির কারণে।

Hilsha2

ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারে ঢুকেই ইলিশের দাম শুনে যেন দম আটকে আসে। যারা এক সময় বছরে কয়েক বার ইলিশ খেতেন, তারা এখন শুধু তাকিয়ে থেকে ফিরে যাচ্ছেন।

গার্মেন্টস কর্মী জাহিদা বেগম বলেন, ‘বাচ্চা কাঁদে ইলিশ খাবে বলে, কিন্তু দাম শুনেই চোখে পানি চলে আসে। এক হাজার টাকায় বাজারই শেষ হয় না, ইলিশ কিনবো কীভাবে?’

অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবী ইমতিয়াজ বলেন, ‘ইলিশ এখন যেন মিডল ক্লাসের নাগালের বাইরেই চলে গেছে। উৎসব ছাড়া তো আর স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।’

গড়দাম গত বছরের তুলনায় ৪০% বেশি

গত বছরের জুলাই মাসে এক কেজির ইলিশ বিক্রি হয়েছিল ১২০০-১৪০০ টাকায়। এবার একই মাপের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২৮০০ টাকায়। অর্থাৎ গড় দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি। বিশেষ করে পদ্মার বড় ইলিশগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে দামি বাজারে—ঢাকার হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিংবা দেশের বাইরের বাজারে।

আরও পড়ুন

‘ইলিশের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো যাবে না'  

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাগরে ইলিশ ধরার অনুমতি মিললেও প্রকৃত অর্থে মাছ উঠছে কম। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে পানির স্তর কমে যাওয়া, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ঠিকভাবে না মানা—এসব কারণে ইলিশের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে ইলিশ রফতানির অনুমতি থাকায় দেশীয় বাজারে সরবরাহ আরও কমে গেছে।

Hilsha3

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইলিশকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত চাহিদা, অপ্রয়োজনীয় রফতানি ও বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় সাধারণ মানুষের নাগাল থেকে মাছটি দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে তারা বলছেন, ইলিশের ওপর চাপ কমিয়ে বিকল্প মাছের দিকে নজর দিতে হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, সরকার ইতোমধ্যেই ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা জারি করে সফল হয়েছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ঠিক রাখাসহ নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ থেকে ইলিশ নিতে চায় চীন

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারের উচিত ইলিশের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া, বাজার মনিটরিং জোরদার করা এবং রফতানিতে সীমা টানা।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইলিশের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে আমাদের রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ইত্যাদি দেশি চাষযোগ্য মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। তবেই বাজারে ভারসাম্য আসবে।’

এমআর/জেবি