images

অর্থনীতি

‘থার্ড ক্লাস’ এমডিতে ফার্স্ট সিকিউরিটির সর্বনাশ!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

২৪ জুলাই ২০২৫, ১০:৪২ এএম

  • ‘লুটপাটের’ অন্যতম সহযোগী ওয়াসেক আলী
  • বেনামি-অখ্যাত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ
  • জাকাত-সিএসআর ফান্ডের টাকাও ‘হরিলুট’
  • নিয়ন্ত্রক সংস্থা দায় এড়াতে পারে না: বিশেষজ্ঞ 

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে এর শীর্ষ তালিকায় রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। শুধু অর্থনৈতিক লুটপাটই নয়, ব্যাংকটি ছিল অনিয়মের স্বর্গরাজ্য। এস আলমের কথাই ছিল ব্যাংকটির সর্বোচ্চ নীতিমালা। এজন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে। আর সেই অযোগ্য এমডিতেই অধঃপতন হয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের এই ব্যাংকের। বেনামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রদান, বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ঋণ, সিএসআর ফান্ডের টাকাও হরিলুটসহ অনেক গুরুতর অনিয়ম হয়েছে ওয়াসেক আলীর হাত দিয়ে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অনেক বিষয় জেনে শুনেও নিশ্চুপ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব অনিয়মের অভিযোগে শেষ পর্যন্ত তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীকে গুরুতর অনিয়ম ও দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগে ব্যাংকের শীর্ষপদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে পরিচালনা পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ, নিজের আত্মীয়-স্বজনকে ঋণ দেওয়াসহ তার বিরুদ্ধে জাকাতের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও পেয়েছে অডিট কমিটি। এমনকি ব্যাংক এমডি হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা উপেক্ষা করে তাকে এমডি পদে বারবার নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বরের এমডি নিয়োগসংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এমডি নিয়োগের নতুন একটি নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালায়ও একই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সৈয়দ ওয়াসেকের শিক্ষাগত সনদের কপি এসেছে ঢাকা মেইলের কাছে। সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতকে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি রয়েছে। তবে একটিতে অর্থাৎ মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণির সার্টিফিকেট রয়েছে।

ওয়াসেক আলী ২০১৫ সালের ৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের ভিত্তিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে এমডি ও সিইও হিসেবে ব্যাংকটির দায়িত্ব নেন। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে তিনি ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তবে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে তিনি বাধ্যতামূলক ছুটিতে ছিলেন।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রমে অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে পরিচালিত একাধিক নিরীক্ষা কার্যক্রমে ওয়াসেক আলীর বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। ২০২৫ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত ১০৭তম অডিট কমিটির সভায় এসব অনিয়মের বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ওই সভার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সঙ্গে সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য কিছু অনিয়মের মধ্যে রয়েছে বেনামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রদান, বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদন, জামানত বা বন্ধকীকৃত সম্পত্তির অস্বাভাবিক মূল্যায়ন, অনাবৃত জামানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ, মুনাফা মওকুফের নামে মূলধন মওকুফ, এমটিডিআর বা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে নিয়মবহির্ভূতভাবে মুনাফা বিতরণের নামে অর্থ উত্তোলন, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুরুতর অনিয়ম এবং আঞ্চলিক বৈষম্য, চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগ ছাড়া এক নির্বাহীকে বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা এবং তাকে বেতন ও বোনাস প্রদান, কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিল উত্তোলনের অনুমোদন এবং জাকাত-সিএসআর ফান্ড বিতরণে অনিয়ম ইত্যাদি।

ব্যাংক লুটেরা এস আলমের লুটপাটের অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াসেক আলী। তার এই অসততা ও অদক্ষতায় অধঃপতনের শীর্ষে উঠে এসেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির ৪৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশ। পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ২০৮ কোটি টাকা, শাখা ২০৬টি এবং লোকসান ৪০৫ কোটি টাকা।

2

ওয়াসেক আলীর সংশ্লিষ্টতায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সিএসআরের টাকা বিতরণেও ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দল। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির গত দুই বছরের বিভিন্ন জেলায় বিতরণ করা হয় অন্তত ১৫ কোটি টাকা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করার তথ্য ব্যাংকে নথিভুক্ত করা হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি তদন্ত দল। এজন্য অর্থগুলো আত্মসাৎ হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। একই সঙ্গে ব্যাংকার্স ফোরামকে দেওয়া ১০ কোটি টাকার বিতরণেও অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত দল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিগত বছগুলোতে ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ফরেন্সিক অডিট করা হয়েছিল। সেখানে ছুটিতে থাকা এমডির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এজন্য বোর্ডের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তার নিয়োগ বাতিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই চিঠির আবেদন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। নতুন নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর একাডেমিক বিষয়সহ তার সততা দক্ষতাগুলো যাচাই করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি কোনো বিষয়ে ঘাটতি থাকে তবে এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়িয়ে যেতে পারে না।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের দায় সংশ্লিষ্ট বোর্ড এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোরও রয়েছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এসব বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তা একদিকে যেমন ব্যাংকের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হচ্ছে, তেমনি অন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্যও একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরও কঠোর হতে হবে।’

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২৮ সালের আগে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেকেই বিভিন্নভাবে নিয়োগ পেয়েছে। নীতিমালা হওয়ার পর পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক বিষয়গুলোর চেয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগে যেসব নিয়োগ হয়েছে তখন অনেকেই অনেকভাবে নিয়োগ পেয়েছে। ২০১৮ সালে নীতিমালা হওয়ার পরে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা তাদের সব বিষয় যাচাই করে তারপর নিয়োগ দিয়েছে। তবে পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা শিথিলতা ছিল। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যাংকের সুপারিশের আলোকে আমরা পুনঃনিয়োগ দিয়েছি। তবে এখন পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রেও সব বিষয় ভালোভাবে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।’

টিএই/জেবি