মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
০৪ জুলাই ২০২৫, ১০:২০ এএম
দেশের আর্থিক খাত এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ব্যাংক খাতের মতোই এখন ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অবলোপন, পুনঃতফসিলের নামে বিভিন্নভাবে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র চেপে রাখা হলেও এখন তা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ এই খাতের এক তৃতীয়াংশের বেশিই ঋণই এখান খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের অর্থাৎ ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি ছিল ৭৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছিল, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
এছাড়াও গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে এই খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। ওই সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
প্রভাবশালী লুটেরা গোষ্ঠীর ছোবল
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এছাড়া নানা অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠী প্রভাব খাটিয়ে খেলাপি ঋণ চেপে রাখলেও এখন তা প্রকাশ পাওয়া এর পরিমাণ বাড়ছে। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, এই কারণে ঋণ পরিশোধ কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে নানা ধরনের ঋণ রয়েছে, তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এত সুযোগ নেই। এ কারণেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্পেটের নিচে খেলাপি ঋণ খুঁজে বের করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সূচক সাময়িক অবনতি হলেও ভালো পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো সামনে ভালো করবে।
'পি কে হালদার ধাক্কা' এখনো কাটেনি
দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থা নতুন নয়। আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাত এখন তার জের টানছে। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের এখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। তারা নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসতে পারেনি। শেয়ারবাজারেও তাদের অবদান নেই বললেই চলে। এ জন্যই একটা বড় ব্যাংকের বড় শাখা দেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের অবদান রাখছে, পুরো খাত মিলেও সেই অবদান রাখতে পারছে না।
আরও পড়ুন-
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, সিভিসি ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, হজ ফাইন্যান্স, ফনিক্স ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, বে লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।
এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর আগের তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
এবিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর লুকানো খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। অবলোপন, পুনঃতফসিল ও মামলার অন্তর্ভুক্ত ঋণ ধরলে খেলাপি আরও বাড়বে। আগের সরকারের আমলে অনেকে একটি কোম্পানি দেখিয়ে ঋণ নিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে ঋণকে খেলাপি করতে দেননি। এজন্য এখন খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
এছাড়া অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন এসব প্রভাবশালী। দুর্বল ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতিও হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকশনে যাওয়ার সময় চলছে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।
টিএই/ইএ