নিজস্ব প্রতিবেদক
২৮ জুন ২০২৫, ১০:০৩ পিএম
উচ্চ খেলাপী ঋণের কারণে উদ্যোক্তাদের আস্থা ও ব্যবসায়ের পরিবেশ সংকুচিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তাসকীন আহমেদ।
তিনি বলেন, শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাংকখাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও আমাদের সামগ্রিক আর্থিকখাত নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত, যার উত্তরণে এখাতে আমূল কাঠামোগত সংস্কারের কোন বিকল্প নেই।
শনিবার (২৮ জুন) ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনার সভাপতির বক্তব্য তাসকীন আহমেদ এসব কথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. মো. ইজাজুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, চলতি বছরের মধ্যমেয়াদে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.২ লাখ কোটি টাকা, এটি মোট অনাদায়ী ঋণের ২৪ শতাংশের বেশি, এ অবস্থা আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনারই প্রতিফলন, পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগে। উদ্যোক্তাদের আস্থার অভাব, আর্থিক খাতে অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও খেলাপী ঋণ আদায়ের ধীরগতি প্রভৃতি বিষয়সমূহ আমাদের শিল্প উৎপাদন, বিশেষকরে এসএমইখাতকে মারাতœকভাবে প্রভাবিত করছে, সেই সাথে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ ৭.৫ শতাংশে নেমে আসার এবং ১০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির হার বিদ্যমান অবস্থাকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে বলে মত প্রকাশ করেন তাসকীন আহমেদ।
এমতাবস্থায় উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ বাড়নোর মাধ্যমে একটি সহায়ক ব্যবসায়িক পরিবেশে নিশ্চিতের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতিমালার মধ্যকার কার্যকর সমন্বয় ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
স্থানীয় ও বৈশ্বিক বর্তমান পরিস্থতি বিবেচনায় দেশের দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ও জমাকৃত সুদের পরিশোধে ৭ বছরের মেয়াদের সময়সীমা আরো ১ বছরের গ্রেস পিরিয়ড অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রস্তাব করেন তাসকীন আহমেদ। সেই সাথে চলমান ঋণ শ্রেণিকরনের সময়সীমায় ৬ মাসের বর্ধিত করার আহ্বান জানান, যেন বেসরকারিখাত কার্যকর পুনঃরুজ্জীবন কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষম হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আর্থিক খাতের ঋণ দাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করতে হবে, তা না হলে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর্থিক ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়ের উপর তিনি জোরারোপ করে। সেই সাথে তিনি আর্থিক খাতের সংষ্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট নীতির সমন্বয় ও নীতির অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থতিতেও ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো চাইলেই সুদের হার কিছুটা হলেও কমাতে পারে, যার ফলে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষকরে এসএমই উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইজাজুল ইসলাম বলেন, বিগত সময়ে আমাদের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষকিছু পরিবারের মধ্যে কুক্ষিতগত করা হয়েছিল, যার ফলে এখাতে অস্বচ্ছতা ও অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার পর উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে, এর সুফল বিশেষকরে দেশের বেসরকারিখাত দেখতে পাবে।
তিনি বলেন, আর্থিক খাতের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশকিছু নীতিমালা সংষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা স্থিতিশীলতা আনায়নে সহায়তা করবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও বেশকিছু ব্যাংক বেশ ভালো ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে, যদিও তাদের ঋণের সুদের হার অনেক বেশি এবং ব্যাংকগুলো চাইলে তা হ্রাস করতে পারে, ফলে উদ্যোক্তাবৃন্দ আরো স্বস্থিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।
তিনি জানান, গত বছরের আগস্টের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ হতে প্রথম ধাপে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং পরবর্তীতে ১৯ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে, এর মাধ্যমে বেসরকরিখাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আসলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, সেই সুদ হার বাজার ভিত্তিক করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বারের সদ্য সাবেক সভাপতি ও পরিচালক আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থীনীতিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার মধ্যে, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ ঘাটতি, আমদানি নিষেধাজ্ঞা, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, বেসরকারিখাতে অপ্রতুল ঋণ প্রবাহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কেবলমাত্র অদক্ষতার কারণেই আন্তর্জাতিক বাজার হতে অতিরিক্ত দরে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের এর জন্য উচ্চ মূল্য প্রদান করতে হচ্ছে।
এছাড়া প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের অভাবে শিল্পের উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যদিও জ্বালানি সরবারাহ নিশ্চিত করা গেলে পণ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, ২০২৫ সালে ঋণের সুদ হার গড়ে ৯ হতে ১ শতাংম উন্নীত হওয়ার কারণে বেসরকারিখাতকে ১.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত সুদ হিসেবে পরিশোধ হবে।
আশরাফ আহমেদ বলেন, ক্রমাবর্ধনমান খেলাপী ঋণের কারণে শিল্পখাতে ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হয়, বিনিয়োগ হ্রাস পায়, ফলে বেসরকারিখাত ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, দেশের ১৪টি ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ, অন্যদিকে ভাল ব্যাংক হিসেবে অবশিষ্ট ৪৭টি ব্যাংকে যার পরিমাণ মাত্র ৫-৭ শতাংশ তাই এই সমস্যা কেবলমাত্র আর্থিক খাতের উপর দেয়া ঠিক হবেনা। আশরাফ আহমেদ বলেন, বেসরকারিখাতের উত্তরণের জন্য ঋণের পুণঃতফসিল ও পুণঃগঠনের সুযোগ থাকা বাঞ্চনীয়। এছাড়াও ব্যাংকখাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংক প্রশাসনের কাঠামোগত সংষ্কারের কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বলেন, ২০২২-২৫ সময়কালে কঠোর মুদ্রানীতির কারণে বর্তমানে প্রায় ৩১.৮ শতাংশ আমদানি সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্পখাতে।
এছাড়াও সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি হোসেন খালেদ, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, বিকেএমই’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান এবং র্যাংগস মটরস লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন।
এমআর/এএইচ