মহিউদ্দিন রাব্বানি
২৪ জুন ২০২৫, ০৮:৩৫ এএম
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে এবার একাট্টা হয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। এনবিআর সংস্কারে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এই চেয়ারম্যান- এমন অভিযোগ সংস্কার ঐক্য পরিষদের।
সংস্কার পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বচ্ছ ও সহনশীল আচরণ করছেন না। খেয়ালিপনা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে নানা ফন্দি-ফিকিক করে যাচ্ছেন।
এনবিআরের কর্মকর্তারা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসনে মরিয়া এই চেয়ারম্যানককে নিয়ে এনবিআরের অভ্যন্তরে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাকে সরানো না গেলে দেশের রাজস্ব খাতে অচলায়ন কাটানো যাবে না। রাজস্ব আদায় কাঠামোর যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে, তা তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জটিল করছেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করছেন। এতে এনবিআরের ভেতরে আস্থা ও মনোবল ভেঙে পড়ছে। এনবিআরের চলমান অচলায়তনের জন্য চেয়ারম্যানের বড় দায় রয়েছে। তার পদত্যাগ ছাড়া এনবিআরের অচলায়তন ভাঙবে না।’
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ মে এক অধ্যাদেশে এনবিআরকে দুই ভাগ করে। এর বিরোধিতা করে গত ২৬ মে পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি ও কলম বিরতির আন্দোলন করে এনবিআরের অধীন কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৫ মে রাতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এনবিআর বিলুপ্ত নয়, বরং এ প্রতিষ্ঠানকে ‘স্বাধীন ও বিশেষায়িত’ বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করা হবে। এর ফলে ২৬ মে কলম বিরতির কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এনবিআর। তবে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ ও তাকে অসহযোগিতা করার ঘোষণা দেয় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
গত ২০ জুন এনবিআর কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনের জন্য ছয় সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে সরকার। এনবিআর সদস্য (কর, লিগ্যাল ও এনফোর্সমেন্ট) ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকীকে এই কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ করে শনিবার (২১ জুন) বিকেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্য পরিষদ। এ সময় সংগঠনের সভাপতি অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার ও মহাসচিব অতিরিক্ত কর কমিশনার মিজ সেহেলা সিদ্দিকা এতে উপস্থিত ছিলেন।

নেতারা বলেন, ইতোমধ্যে সংস্কার কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক বদলি ও নিপীড়নের খড়গ নেমে এসেছে। আবার, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকা সত্ত্বেও রাজস্ব ভবন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে উস্কানিমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি, অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। তার মাধ্যমে রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক কার্যক্রম সময়ক্ষেপণ বৈ কিছু নয় বলে ঐক্য পরিষদ মনে করে। এর আগে থেকেই ঐক্য পরিষদ রাজস্ব ভবনে চেয়ারম্যানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।
নতুন কমিটি প্রসঙ্গে এনবিআর সংস্কার পরিষদের বক্তব্য: রাজস্ব অধ্যাদেশ সংশোধনের লক্ষ্যে এনবিআরের কর, কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের ছয়জন সদস্য সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, এই কমিটিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কোনো প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এমনকি তাদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনাও করা হয়নি।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানায়, বর্তমান চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে রাজস্ব সংস্কার সম্ভব নয়, কারণ তিনি এটি বাস্তবায়ন হতে দেবেন না। পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নকারী যে ৪৪ জন (এর মধ্যে ছয়জনকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছে) আমলার তালিকা করা হয়েছে, তার মধ্যে এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান তিন নম্বর ক্রমিকে রয়েছেন। সুতরাং, সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে তিনি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করবেন।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, এনবিআর সংস্কারে সরকার আমাদের আশ্বাস দিলে আমরা কর্মসূচি স্থগিত করি। কিন্তু বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে স্বয়ং সংস্থাটির চেয়ারম্যান। ফলে চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ চার দফা আদায়ে আমাদের সর্বাত্মক কর্মসূচি চলবে।
গতকাল সোমবার আগারগাঁও এনবিআরের সামনে কাফনের কাপড় পরে কলম বিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন সংস্থাটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেশের সব কর অঞ্চল, ভ্যাট ও কাস্টমস অফিসে কাজ বন্ধ রেখে কর্মকর্তারা অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। সেখানে চেয়ারম্যানের অপসারণ, নিপীড়কমূলক বদলি, এনবিআর সংস্কারসহ চার দফা দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
এর মধ্যে রয়েছে- মঙ্গলবার (২৪ জুন) আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রফতানি ব্যতীত কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দফতরে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঢাকাস্থ কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের রাজস্ব ভবনে অবস্থান কর্মসূচি ও কলম বিরতি এবং ঢাকার বাইরে স্ব-স্ব দফতরে অবস্থান কর্মসূচি, কলম বিরতি এবং চেয়ারম্যান ও তার দোসরদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ চলবে। ২৫ ও ২৬ জুন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রফতানি ব্যতীত কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দফতরে কলম বিরতি, অবস্থান কর্মসূচি এবং চেয়ারম্যান ও তার দোসরদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ চলবে। এবং ২৭ জুনের মধ্যে বদলি আদেশ বাতিল ও এনবিআরের চেয়ারম্যানকে অপসারণ না করা হলে আগামী ২৮ জুন লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন চলবে।
এর আগে আন্দোলন দামাতে এনবিআরের পাঁচ উপ-কর কমিশনারকে হঠাৎ বদলি করা হয়েছে। রোববার (২২ জুন) এনবিআর থেকে এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়।
বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে দুজন আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের, একজন এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের এবং বাকি দুজন ঢাকা ও কুমিল্লার কর অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। চলমান এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই বদলিকে অনেকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে না দেখে পরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন ঐক্য পরিষদের নেতারা।
চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
সংস্কার পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বচ্ছ ও সহনশীল আচরণ করছেন না। রাজস্ব আদায় কাঠামোর যে সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে, তা তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জটিল করছেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করছেন। এতে এনবিআরের ভেতরে আস্থা ও মনোবল ভেঙে পড়ছে।

অতিরিক্ত কর কমিশনার ও ঐক্য পরিষদের নেতা মির্জা আশিক রানা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবো। ইতোমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।’
আন্দোলন সফল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনের সম্মুখ সারির এই নেতা বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে, দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দাবি পূরণে আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাচ্ছি। চেয়ারম্যানের একক খেয়ালিপনা ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করছেন। ফলে আমরা আমাদের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছি।’
এনবিআর সংস্কারের খোদ চেয়ারম্যানকে দায়ী করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের মূলত বিরোধ নেই। আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের (চেয়ারম্যান) অসহযোগিতায় সংস্কার পিছিয়ে গেছে। আমরা চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই।’
এ বিষয়ে পরিষদের সভাপতি ও নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, মূল্য সংযোজন করের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, ‘চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এনবিআরে অস্থিরতা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে। তিনি পদে থাকলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব সংস্কার সম্ভব নয়। তাই আমরা তার পদত্যাগ চাই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও এনবিআর চেয়ারম্যানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমআর/জেবি