সাখাওয়াত হোসাইন
০৫ জুন ২০২৫, ০৮:৩৯ এএম
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতিবছর মতো এবারও বসেছে রাজধানীর অন্যতম বড় পশু কেনাকাটার হাট হাজারীবাগ। গেল কয়েক হয়েছে এই হাটে পশু কেনাকাটা হচ্ছে। তবে বিগত অন্যান্য বছরে মতো এবার হাঁকডাক নেই হাজারীবাগে। কমেছে ক্রেতা ও দর্শনার্থী। নেই প্রতিবারের মতো চিরচেনা ভিড়। সব পশু বিক্রি করতে পারবেন কি না– এনিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গেল কয়েকদিন ধরে এবার কোরবানির হাট বসেছে হাজারীবাগে, সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোরবানির পশু আসছে এই হাটে। সারি সারি সাজানো আছে গরুর লাইন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন বিক্রেতা। কোনো কোনো ক্রেতা গরুর বেপারীদের সঙ্গে দরদাম করছেন। হাটে ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের সংখ্যা কম। আবার কোনো কোনো গরুর বেপারী অলস সময় পার করছেন, অপেক্ষায় আছেন ক্রেতার। কারও বিক্রি হয়নি একটি গরুও, তারা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
হাটে ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু কয়েক লাখ টাকার গরু উঠেছে। ছোট, মাঝারি আর বড় সবধরনের গরু রয়েছে এই হাটে।
নাটোর থেকে গরু নিয়ে রাইসুল ইসলাম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ছোট-বড় সবলিমিয়ে ১৬ গরুর নিয়ে আসছি তিন দিন হলো। এখনো কোনো গরু বিক্রি করতে পারিনি। ক্রেতাদের চাহিদা ছোট গরুর দিকে। ছোট গরুগুলোর কাছে ক্রেতা বেশি আসছে। আশা করি, বৃহস্পতিবার বা তারপরের দিন বিক্রি করতে পারব।
তিনি জানান, গরুর বিক্রি করতে না পারলে লোকসান হবে। ভালো দাম পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। গরুগুলো খুবই যত্ন সহকারে লালন-পালন করা হয়েছে।
দুশ্চিন্তায় গরুর ব্যবসায়ীরা
গরুর নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন হাজারীবাগের হাটে নিয়ে আসা কোনো কোনো ব্যবসায়ী। জানতে চাইলে গরুর বেপারী লতিফুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে মোট ৩০টি গরু আছে। অন্যান্য বছর ঈদের এই সময়ে পাঁচ-ছয়টি গরু বিক্রি করেছি। এবছর আর ঈদের বাকি আছে মাত্র দুদিন, এখনো কোনো গরুর বিক্রি করতে পারিনি। গরু বিক্রি করতে না পারলে ব্যবসায় লোকসান হবে। সেইসঙ্গে গরুর ব্যবসা করার মনোবল হারিয়ে যাবে। গরুর নিয়ে আসতে অনেক খরচ হয়েছে। সেইসঙ্গে পরিশ্রম তো আছেই।
আরেক ব্যবসায়ী মাহমুদ হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্রেতা যা রয়েছে, তারা দাম কম বলছে। এই দামে বিক্রি করলে লোকসান হবে। এ বছর বাজার ভালো মনে হচ্ছে না। তিন লাখ টাকার গরুর ক্রেতা দেড় লাখ টাকা বলে। এই দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে। গরুর সব খাদ্যের দাম বেশি।

তিনি আরও বলেন, গরু পালন করতে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। এখন গরুর যথাযথ দাম না পেলে আমরা তৃণমূল গরুর খামারি বা ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়ব। যেটি পরবর্তী সময়ে একটা ধাক্কা খেতে হবে। আমরা গরুর দাম বেশি চাই না, ন্যায্য মূল্যটা চাই। যাতে আমরা টিকে থাকতে পারি।
কুষ্টিয়া থেকে আসা আরেক গরুর ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্রেতা যা দাম বলছে, মনে হচ্ছে গরুতে এবার সবই লস। গরুতে ভালো ব্যবসা হবে না কারোরই। বাজারের অবস্থা খুবই দুর্বল। আগে যা গরু বিক্রি হতো, এখন তাও হচ্ছে না। খাদ্যের দাম বেশি হলেও গরুর দাম কম। এভাবে চললে অনেকেরই লোকসান হবে।
তিনি আরও বলেন, খাবার, চিকিৎসা, পরিচর্যা ও শ্রমিকের খরচ মিলিয়ে এ ধরনের একটি গরু পালতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। ক্রেতাদের কাছে দাম তুলনামূলক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই।
ক্রেতাদের অভিযোগ
গরু বিক্রেতাদের দাম চাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ক্রেতারা। ঢাকার আজিমপুর থেকে গরু কেনার জন্য হাজারীবাগ পশুর হাটে এসেছেন সরকারি কর্মকর্তা নুরুল আমিন। এই বাজারের গরুর দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি। জানতে চাইলে নুরুল আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি অনেক গরু দেখেছি। এবছর দাম বেশি চাচ্ছে মনে হচ্ছে। যেই গরুর দাম দেড় লাখ টাকা হওয়ার কথা, সেই গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা। দামেরও অনেক পার্থক্য আছে।
তিনি আরও বলেন, দাম বেশি চাওয়া হলে ন্যায্যমূল্যে ভোক্তারা গরু কিনতে পারবেন কি না সেটি সন্দেহ আছে। তবে ব্যবসায়ীদের উচিত হলো ন্যায্যমূল্য চাওয়া যাতে ভোক্তারা স্বাচ্ছন্দে কিনতে পারেন। আর না হলে অনেক বেপারীর কাছে গিয়ে দামাদামি করে কিনতে হবে।
মাইদুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতা বলেন, প্রতিবছর এই হাট থেকে গরুর কিনি। গতবছরও ন্যায্যমূল্যে গরু কিনেছি। আশা করি, এবারও ভালো গরু কিনতে পারবো। কোরবানীর যেই উদ্দেশ্য, সেটি হাসিল করতে পারব। আর কিছু কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যেই দাম, সেই দামের চেয়ে বেশি চান। এটি ঠিক নয়।
কমছে কোরবানি
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সাল মিলিয়ে গড়ে বছরে ৫৪ লাখের কিছু বেশি গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ গরু-মহিষ কোরবানি কমেছে গড়ে ১৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, গরুই বেশি কোরবানি হয়। মহিষের সংখ্যা থাকে হাজার পঞ্চাশেক।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বছরে গড়ে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৩৫ হাজার প্রাণি, যা আগের চেয়ে দুই লাখ কম। যদিও বছর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে কোরবানি বাড়ার কথা থাকলেও উল্টোটা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরুর দাম এতটাই বেড়েছে যে অনেকে কোরবানি দিতে পারছেন না। কেউ কেউ অতীতে একটি গরু কোরবানি দিতেন, এখন দেন ভাগে। কেউ কেউ গরুর বদলে ছাগল কোরবানি দিচ্ছেন। ভাগে গরু কোরবানি দেওয়ার চেয়ে ছাগলে খরচ কম।
এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল। অন্যদিকে গরু ও মহিষের দামও বেড়েছে। ফলে কোরবানি দেওয়া অনেকের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।
ছোট গরু বিক্রি বেশি
ঈদুল আজহায় ছোট ও মাঝারি গরু বিক্রি বেশি হচ্ছে। তবে ছোট গরুর চাহিদা রয়েছে তুঙ্গে। যেসব গরুর দাম লাখের আশেপাশে। ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য গরু কিনতে ধানমন্ডি থেকে হাজারীবাগের পশুর হাটে এসেছেন এমদাদ হোসেন। পশুর হাট থেকে মাঝারি আকারের একটি গরু কেনেন তিনি। বিকেলে (৪ জুন) ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় তার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিক্রেতা দেড় লাখ টাকা দাম চেয়েছিলেন। গরুটি পছন্দ হওয়ায় এক লাখ টাকা দাম বলি। পরে আরও ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে।
চার দিন হয়েছে হাজারীবাগে গরু নিয়েছে এসেছেন সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ী সবুজ মিয়া। জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানালেন, এবার ছোট, মাঝারি বড় সবমিলিয়ে মোট ২৪টি গরু হাটে এনেছেন। এরমধ্যে ছোট গরুর সংখ্যা বেশি। এখন পর্যন্ত তাঁর তিনটি ছোট গরু বিক্রি হয়েছে। এর একটি ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। অন্য দুটির একটি ১ লাখ ১৫ হাজার, অপরটি ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার ঢাকায় মোট ২০টি পশুর হাট বসছে—ঢাকা দক্ষিণে ৮টি ও উত্তরে ১২টি।