images

অর্থনীতি

‘শিক্ষিত খাসি’: কোরবানির অনলাইন বিপণনে নতুন ট্রেন্ড

মাহাবুল ইসলাম

০৩ জুন ২০২৫, ০৮:০২ পিএম

ঈদুল আজহার মৌসুম এলেই দেশজুড়ে জমে ওঠে কোরবানির পশুর হাট। গরু, খাসি, মহিষ কিংবা উট—সবকিছুতেই থাকে বাহারি দাম, গঠন ও জাতের অনুসন্ধান। তবে এখন কেবল পশুর চেহারা কিংবা ওজন নয়, নজর কাড়ছে তাদের নামও। 

গত কয়েক বছরে কোরবানির হাটে দেখা গেছে কিছু বিচিত্র নামের পশু—‘বাহুবলী গরু’, ‘বস খাসি’, কিংবা ‘টিকটক গরু’। এ তালিকায় এবার যোগ হলো আরেকটি নাম ‘শিক্ষিত খাসি’। এটি—মজার ছলে মনে হলেও বস্তুত সাড়া জাগানো একটি বিপণন কৌশল।

রাজধানী ঢাকার নতুন বাজার এলাকার একটি খামার অনলাইনে বিক্রির জন্য এক খাসির নাম দিয়েছে ‘শিক্ষিত খাসি’। মালিকপক্ষ বলছে, নামটি নিছক কৌতুক নয়, বরং এটি তাদের বিক্রয় কৌশলের অংশ। ফেসবুকে ‘মর্নিং এগ্রো’ নামের পেজের মাধ্যমে এই খাসি বিক্রি করা হচ্ছে। লাইভ ওয়েট অনুযায়ী প্রতি কেজির দাম রাখা হয়েছে ৬৫০ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ সাব্বির ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা যেসব খাসি উন্নত জাতের, কান লম্বা, স্বাস্থ্যবান এবং ওজন ৫০ কেজির আশপাশে থাকে, তাদেরই ‘শিক্ষিত খাসি’ নামে বাজারজাত করছি। এতে ক্রেতাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।’

এই নাম শুনে অনেকেই মজা পেলেও এটি যে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে বেশ কার্যকর, তা ব্যবসায়িক সাফল্যেই প্রমাণিত। সাব্বির জানান, ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে প্রতিদিন বেশ কিছু খাসি বিক্রি হচ্ছে। অনেকে আগ্রহ করে শুধু ‘শিক্ষিত খাসি’ দেখতে চান, দাম না জেনে শেয়ার করে দিচ্ছেন, জিজ্ঞেস করছেন খাসির পড়াশোনার গল্প!

পশুর নামে ব্যবসা জমজমাট

পণ্যের ব্র্যান্ডিং আজকের ডিজিটাল বাজারে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কোরবানির পশুর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিত্তিক বিক্রয় প্ল্যাটফর্মগুলোতে এখন যে কেউ একটি নাম দিয়ে পশুকে ব্র্যান্ড করে তুলছে।

বাজার বিশ্লেষক এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফায়সাল আহম্মেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মানুষ এখন ‘কনটেন্ট’ খোঁজে। একটি গরুর বা খাসির গল্প যদি হয় আলাদা, যদি তাতে বিনোদন থাকে বা মজার কিছু থাকে, তাহলে মানুষ সেটি দেখে, শেয়ার করে, মনে রাখে। ফলে বিক্রেতার পরিচিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে যায়। এটা স্মার্ট বিজনেস। তবে ব্যান্ডিং বিষয়টি বির্তকিতও হতে পারে। মানুষ যদি সেটা গ্রহণ না করে তাহলে বিপরীত কিছুও হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, “শিক্ষিত খাসি’ নামটি যেমন কৌতুকপূর্ণ, তেমনি প্রতীকী। এটি এমনও ভাবতে পারেন, পশুটিকে পরিচর্যা করা হয়েছে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে, ভালো খাওয়ানো হয়েছে, মানসম্মত পরিবেশে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ খাসি ‘শিক্ষিত’ মানে এটি সস্তা বা অগোছালো নয়, বরং প্রিমিয়ামও হতে পারে।”

যেভাবে অনলাইন হাটের উত্থান

বাংলাদেশে কোরবানির পশুর অনলাইন বেচাকেনা প্রথম আলোচনায় আসে কোভিড মহামারির সময়। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে মানুষ তখন অনলাইন হাটে ঝুঁকে পড়ে। সেই ধারা এখন আরও সুসংগঠিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন খামার ও প্রতিষ্ঠান নিজেরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পশু বিক্রি করছে।

ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব এবং ওয়েবসাইট ভিত্তিক ‘লাইভ সেলিং’ খুব জনপ্রিয়। একটি লাইভে যদি পাঁচ হাজার মানুষ সংযুক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ১% মানুষও যদি ক্রয় করে, তাহলে সেটি বিশাল লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়।

নামের ভারে পশুর দাম বাড়ে

‘শিক্ষিত খাসি’র দাম প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা, অর্থাৎ ৫০ কেজির একটি খাসির দাম দাঁড়ায় প্রায় ৩২,৫০০ টাকা। ঢাকার হাটে একই ওজনের খাসির দাম সাধারণত ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তবে অনলাইনের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা বেশি হওয়ার পেছনে রয়েছে পরিবহন, খাদ্য, ব্র্যান্ডিং এবং গ্রাহকসেবা।

শাহাদাত হোসেন নামের এক ক্রেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, হাটে এসে দাম দর করে কিনলে কিছুটা কমে পাওয়া যায়। কিন্তু অনলাইনে সুবিধা হলো, ঘরে বসে বাছাই করে নেওয়া যায়। কিছু অতিরিক্ত দাম হলেও অনেকে এখন নিরাপদে পশু কিনতে চায়।

পশুর নাম নিয়ে বিতর্ক

‘শিক্ষিত খাসি’ নামটি হয়তো মজার, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে আধুনিক বাজার অর্থনীতির কার্যকর কৌশল। অনলাইন ভিত্তিক পশু বিক্রির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে বিক্রেতারা এখন নাম, গল্প ও ভিন্নধর্মী বিপণনের ওপর নির্ভর করছেন। ক্রেতারা যেমন খুঁজছেন ভালো মানের পশু, তেমনি খুঁজছেন নতুন কিছু দেখার ও জানার অভিজ্ঞতা। ফলে পশুর হাট এখন আর শুধু হাটে সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়ছে স্মার্টফোন স্ক্রিনে, মেসেঞ্জার চ্যাটে ও সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডে।
তবে এই নামকরণ সবাই যে ভালো চোখে দেখছেন এমন নয়। কেউ কেউ মনে করছেন, কোরবানির পশুর সঙ্গে ‘শিক্ষিত’ শব্দের ব্যবহার একধরনের ব্যঙ্গাত্মক।

গবেষক ও কবি ইমরান মাহফুজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোরবানি একটি ইবাদত। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুতেই সংবেদনশীলতা থাকা উচিত।এটা রুচিসম্মত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ না। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু উন্নতি হচ্ছে না আমাদের। এটা তার প্রমাণ। মানুষ সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য এতোটা হাসির পাত্র করতে পারে নিজেকে। এটা ভাবা যায় না। সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা অভাবের কারণে এমন হয়।’

এমআই/ইএ