images

অর্থনীতি

‘আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না’

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ মে ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, কমপ্লায়েন্স ও আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
 
আজ রোববার (২৫ মে) ডিসিসিআই আয়োজিত ‘চামড়া শিল্পের কৌশল নির্ধারণ: এলডিসি পরবর্তী সময়ে টেকসই রফতানি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাতের পর বাংলাদেশে রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস চামড়া খাতে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এলডিসি পরবর্তী সময়ে এ খাতে প্রাপ্ত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো ক্রমাগত হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ এ খাতে নিজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি, কারণ বৈশ্বিক চামড়া শিল্পে আমাদের অবদান ১%-এর কম অবদান রেখেছে। এমন বাস্তবতায়, এলডিসি পরবর্তী সময়ে এ খাতের রফতানিতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদের দক্ষতার উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন, ভ্যালুচেইন শক্তিশালীকরণ, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সহযোগিতার ওপর জোর দিতে হবে।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি চামড়া শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে একটি সহায়ক অবকাঠামো তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যার ভিত্তিতে বেসরকারিখাত আগামী ১০ বছরে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত উক্ত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এছাড়াও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম এবং এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান নানাবিধ প্রতিকূলতা নিরসনে শিল্প মন্ত্রণালয় সহায়ক নীতির পরিবেশ প্রদানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে; যার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। চামড়া শিল্পের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি বিস্তৃত ইকো-সিস্টেম প্রবর্তনের উদোগ গ্রহণ করেছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে চামড়া শিল্পের পরিবেশগত অবকাঠামো উন্নয়ন, সনদ প্রাপ্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

বিসিক চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, চামড়া খাতে সিইটিপি’র (পরিবেশবান্ধব কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার) বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাভারে স্থাপিত সিইটিপি’র ক্যাপাসিটি বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার এবং পিক সিজনে (কোরবানির সময়) এ খাতে চাহিদা থাকে ৩২-৩৫ হাজার কিউবিক মিটার; সিইটিপি’র সক্ষমতা ২০-২৫ হাজার কিউবিক মিটারে উন্নীতকরণে একটি টেকনিক্যাল টিম কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে সিইটিপি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, আরো ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এ খাতে পরিবেশ দূষণ রোধে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। সেইসঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়েও সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে। চামড়া খাতে নতুন বাজার তৈরি, উদ্ভাবন ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। 
     
এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বহির্বিশ্বে এ শিল্পের ইমেজ সংকট রয়েছে, সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট না থাকার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি থেকে উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। 

তিনি আরও বলেন, সিইটিপি থাকলে সম্মিলিতভাবে ব্যয় কম হবে এবং মনিটর করা সহজ হবে। যেকোনোভাবে এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট পাওয়া সহজ হবে এবং এফডিআই আকর্ষণ সহজ হবে। যেহেতু আমাদের প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল রয়েছে; তৈরি পোশাক খাতের মতো রফতানিমুখী সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন এবং আশা করি আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন পরিলক্ষিত হবে।

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেদার গুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং এমসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ হতে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সিইটিপি পুরোপুরি চালু করা যায়নি; ফলে এ খাতের কাঙ্ক্ষিত রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এলডব্লিউজি’র মতো আমাদের আন্তর্জাতিক কোনো সনদ না থাকায় বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারছে না এবং এ খাতের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এছাড়াও চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সের অনুপস্থিতির বিষয়টিও অন্যতম কারণ। চামড়া খাতের রুগ্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান এবং যারা এ খাত থেকে বের হতে আগ্রহী, তাদেরকে প্রস্থানের সহজ সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। যাতে বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় ঋণপ্রাপ্তি সহজতর হয়। চামড়া শিল্পের বার্ষিক রফতানি ১.২ হতে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে; তবে তৈরি পোশাকখাতের মতো আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাতে বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি সম্ভব, যা ২০৩৫ সালে ১০ বিলিয়নেও উন্নীত হতে পারে। চামড়া খাতের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ক্লাইমেট ফাইন্যান্স ফান্ড হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

নাসিম মঞ্জুর বলেন, চামড়া শিল্পটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তাই এটিকে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ডব্লিউটিও অনুবিভাগ) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক, বিসিএসআইআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সালমা আহমেদ, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মো. নুরুল ইসলাম, বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান, জেনিস সুজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির খান এবং অস্টান লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা অংশগ্রহণ করেন। 

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ আসবেই, এগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারলে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হবে।

তিনি পরিবেশ ও শ্রম খাতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতের জন্য বেসরকারিখাতের প্রতি আহ্বান জানান। সিইটিপি’র সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকার ও বেসরকারিখাত একযোগে কাজ করতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

বিডার মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, আগামী ১৫ বছরে আমাদের অর্থনীতি দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় জরুরি। 

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য আমাদেরকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। সম্ভাবনাময় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিডা গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছে, যার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। সম্প্রতি বিডা কর্তৃক প্রবর্তিত হিটম্যাপে চামড়া খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্স অনুসরণে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি এবং এ খাতের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। এছাড়াও চামড়া শিল্পে ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপনে গ্রিন ফান্ড থেকে স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানাই।

অস্টান লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা বলেন, এ খাতে সাপ্লাই চেইন বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অনুপস্থিতির কারণে কাঁচামালসহ অন্যান্য সবকিছুই আমদানি নির্ভর এবং আমদানি নির্ভরতা দিয়ে বেশিদিন বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয়, তাছাড়া আমাদের এলডব্লিউজি সনদও নেই। চামড়া খাতে আমাদানিকৃত পণ্য আনার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে রফতানির লিড টাইম বেড়ে যাচ্ছে, ফলে প্রতিনিয়ত আমরা বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছি।   

জেনিস সুজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির খান বলেন, সাপ্লাইচেইনের অনুপস্থিতি ও কাস্টমস জটিলতার কারণে রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ খাতে পণ্যের মূল্য সংযোজনের সুযোগ করে দিলে স্বল্প সময়ে বার্ষিক রফতানি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। 

বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান চামড়া খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইটিপি স্থাপনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সেইসঙ্গে ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সিইটিপি ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারের সহযোগিতার ওপর জোরারোপ করেন। বিদ্যমান শুল্ক ও কর ব্যবস্থাপনার সংস্কারের পাশাপাশি নীতি সহায়তা না দিলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ কঠিন হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।  

মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ কোরবানির পশুর চামড়ার সঠিক মূল্য নির্ধারণের ওপর জোরারোপ করেন।

এমআর/এফএ