ঢাকা মেইল ডেস্ক
০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৬ এএম
দেশের কয়েকটি অঞ্চলে গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে সোমবার অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলের একপর্যায়ে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় কেএফসি, বাটা, পিৎজা হাট, ডোমিনোজ পিৎজাসহ প্রায় একডজন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয় এবং সেখানে ভাঙচুর ও মালামাল লুট করা হয়। এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এর ফলে নতুন করে নিরাপত্তা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এটি এমন একটি সময়ে ঘটেছে, যখন বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার ঢাকায় একটি চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করেছে। এতে কয়েকশ বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করতে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। হামলা ও লুটপাটের এই ঘটনা তাদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে, এবং এ নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—এমন পরিস্থিতিতে তারা সরকার এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে কতটুকু আস্থা রাখতে পারবেন।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘এই ধরনের ঘটনার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে নেতিবাচক বার্তা পেয়েছে, তা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা দেশের বাজার ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিতে পারছি না, যা দেশের ভবিষ্যত অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।’
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। পুলিশ প্রধানও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য তৎপরতা শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি আসার জন্য সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো দায়ী। মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেছেন, ‘গত কয়েক মাসে একের পর এক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা প্রতিহত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এর ফলে অপরাধীরা সাহস পেয়েছে এবং এই ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটানো সম্ভব হয়েছে।’
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিলেট মহানগরের দরগা গেট এলাকার বাটা শোরুমে হামলার পর ওই শোরুম থেকে জুতা, মোজা, বেল্টসহ বিভিন্ন পণ্য লুট করা হয়। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে হামলাকারীরা লুটপাট করতে দেখা গেছে। সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হক জানিয়েছেন, প্রযুক্তির সাহায্যে তারা হামলাকারীদের শনাক্ত করেছেন এবং ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতারদের মধ্যে কয়েকজন সেগুলো বিক্রির জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।
এছাড়া খুলনা মহানগরীতেও কেএফসি, ডোমিনোজ পিৎজা এবং বাটার শোরুমে হামলা চালানো হয়, যার ফলে সেখানেও ভাঙচুর এবং লুটপাট হয়। পুলিশ জানিয়েছে, খুলনায় ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এবং বেশিরভাগ গ্রেফতারদের বয়স তরুণ। তাদের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত চলছে, এবং এই হামলার পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো ধরনের উসকানি ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের প্রচারণা চালানোর পরই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একাংশ এসব হামলা চালিয়েছে। এটি আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল, এমন অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলছেন, ‘এটি একটি সুপরিকল্পিত ঘটনা হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে অনেক সময় উসকানি দেওয়া হয় এবং এর ফলে সংঘবদ্ধ হামলা হতে পারে।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের হামলা সমাজে একদিকে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি করতে পারে, অন্যদিকে এর ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা ও বিনিয়োগের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, নইলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে।’
এমন পরিস্থিতির কারণে অনেক ব্যবসায়ী এখন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও খুলনাসহ অন্যান্য জেলায় বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার কারণে তাদের কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকায় কেএফসি ও বাটা শোরুমে অনেক প্রতিষ্ঠান তার শাখা বন্ধ রেখেছে বা দেরিতে খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাটা বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের দোকানে আক্রমণ হয়েছে, আমাদের মালামাল লুট করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়।’ তারা জানান, নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে কিছু এলাকায় তাদের শোরুম দেরিতে খোলা হয়েছে এবং প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়েই পরিস্থিতি বর্তমানে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়, তবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাতে পারে। বিনিয়োগকারীরা তাদের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে উদ্বিগ্ন, যা বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যাতে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত না হন, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি।’
সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এমন অবনতি দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে, এবং এর ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এবং ভবিষ্যতের প্রতি শঙ্কা বাড়তে পারে। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশব্যাপী এ ধরনের ঘটনা আরও ঘন ঘন ঘটতে পারে, যা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এইউ