images

অর্থনীতি / জাতীয়

বিদেশি পর্যটকরা বাংলাদেশে কম আসেন কেন, বাধা কোথায়?

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৪ পিএম

images

পাহাড়, ঝর্ণা, বনবাদাড়, ঐতিহাসিক স্থানসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর নদী-মাতৃক বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকলেও তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের মতো বিরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানগুলো থাকার থাকার পরও বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বাংলাদেশে কেন কমছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত সেবাদানে দক্ষতার অভাব, হোটেল ভাড়া-খাবারে পর্যটকদের অতিরিক্ত খরচসহ দুর্বল ব্যবস্থাপনা, আকর্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এর পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের ই-ভিসা পাওয়া এবং সুন্দরবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ব অনুমতি পেতে বিলম্বের কারণও অন্যতম।

তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই কাজ এগিয়ে চলছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

দেশের পর্যটন নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশিদের জন্য ই-ভিসা সহজ করণ, সুন্দরবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুমতি পাওয়াকে সহজ এবং রাস্তাঘাটের উন্নতি ঘটাতে পারলে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বাড়বে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, শ্রীলংকার কলম্বো এবং নেপালের কাঠমান্ডুর তুলনায় ঢাকার হোটেল ভাড়া দ্বিগুন। এছাড়া খাবারের দাম বেশি কিন্তু মান সে অনুযায়ী নয়। এরপরও বাংলাদেশের পর্যটক আসে। যাদের অনেকেই হোটেলে থাকেন না। শুধুমাত্র বাংলাদেশে আসেন এদেশের কালচার এবং গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য।

এসবের মধ্যেও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে পর্যটনের উন্নয়নে একটি মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়েছে সরকার। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির গত ১০ বছরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বেড়াতে আসেন ভারতীয়রা। এর পরের দেশ হিসেবে রয়েছে চায়না, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড। এছাড়া জাপান, মালেশিয়া, সাউথ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, নেপাল, জার্মানি এবং সৌদি আরবের নাগরিকরাও পর্যটক হিসেবে বেড়াতে আসেন। 

বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে এসব দেশ থেকে পর্যটক এসেছিল ১ লাখ প্রায় ৩৪ হাজার, ২০১৫ সালে ১ লাখ সাড়ে ২৬ হাজার, ২০১৬ সালে ১ লাখ সাড়ে ৮২ হাজার, ২০১৭ সালে ২ লাখ সাড়ে ৩২ হাজার, ২০১৮ সালে ২ লাখ সাড়ে ৬৭ হাজার, ২০১৯ সালে ৩ লাখ ২৩ হাজার। এ বছর যে পর্যটক বাংলাদেশে এসেছেন তা করোনার পর থেকে ভাটা পড়তে শুরু করে। আবার এখন তারা আসতে শুরু করেছে। এছাড়াও ২০২২ সালে এসেছে ৫ লাখ ২৯ হাজার ও ২০২৩ সালে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। গেল বছরের হিসেব এখনো হাতে আসেনি পর্যটন বোর্ডের কাছে।

Tanguar_haor,_Bangladesh_01
অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশ

পর্যটন বোর্ডের এই তথ্য ছাড়াও বেসরকারি তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যারা গার্মেন্টস সেক্টর সংক্রান্ত কাজের জন্য আসেন তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেড়াতে যান। এই সংখ্যা হয়তো ট্যুরিজম বোর্ডের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না। 

তবে বাংলাদেশের পর্যটন খাত গত ১০ বছরে অনেক এগিয়ে গেছে। আগে লোকজন ট্যুরিজম বলতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া এবং পিকনিককে বোঝাতো। সেই ধ্যান ধারণা থেকে এখন বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে খোদ বাংলাদেশিরাই নানা ভূমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশে এখন দিন দিন ভালো মানের ইউটিউবার এর সংখ্যা বেড়ে চলছে। যারা ভ্রমণকাহিনী দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশের ট্যুরিজমকে তুলে ধরছে। 

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর সাবেক প্রেসিডেন্ট শিবলুল আযম কোরেশী ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, বাংলাদেশের ডোমেস্টিক ট্যুরিজম ব্যাপক হারে বেড়েছে। তবে বিদেশি পর্যটক কম আসার পেছনে অন্যতম কারণ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ে তেমন প্রচার নেই। ফলে বিদেশিরা বাংলাদেশের ট্যুরিজম সম্পর্কে তেমন জানেন না। প্রচারের অভাব অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশ নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে যেগুলো আমাদের পর্যটন খাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

তিনি বলেন, এখনো বহির্বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশকে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের দেশ হিসেবে চিনে থাকে। যদিও বাংলাদেশে বন্যা, খরা ও জলোচ্ছ্বাস রয়েছে। কিন্তু এসব মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশে এখন দুর্ভিক্ষ নেই। এটা বহির্বিশ্বকে আমরা এখন বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। যদিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো নয় বলে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু আমি মনে করি ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভালো। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো নয় বলে মার্কেটে একটি নেতিবাচক প্রচার রয়েছে। এটিকে নিউট্রাল করার জন্য নেগেটিভের পাশাপাশি আমাদের পজেটিভ প্রচারণা থাকা দরকার।

AmeemEhsan_sunset_coxbazar
কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত উপভোগ করছেন এক পর্যটক

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশটা ছোট হলেও পর্যটক আকর্ষণের কোনো ধরনের অভাব নেই। আমাদের বিনোদন এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলো নিয়ে আমরা সঠিকভাবে চালাতে পারছি না বলে বিদেশ পর্যটকরা আসছে না। বিদেশে আমাদের পর্যটনকে তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে বিদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রে থাকা আমাদের মিশনগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। তাদের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন তুলে ধরতে হবে বহির্বিশ্বের কাছে। যেহেতু আমাদের মোটা অংকের টাকা দিইনি প্রচারের জন্য এ কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে এবং ভালো ভালো ডকুমেন্টারি তৈরি করে বিদেশে থাকার মিশনগুলোর মাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে। এছাড়া বিদেশ থেকে ইউটিউবার এবং ব্লগারদের এনে আমাদের পর্যটন স্পটগুলোর ভিডিও তুলে ধরা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

দেশে ১৬০০ পর্যটন স্পটের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা ১৪০০

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি পর্যটক কম আসার পেছনে আরেকটি কারণ হলো অন-এরাইভাল ভিসা। অনেক সময় বিদেশি পর্যটকরা এসে আমাদের বিমানবন্দরে আটকে থাকেন। ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া ও কাগজপত্র ক্লিয়ার করাসহ নানা জটিলতায় তিন চার ঘণ্টা লেগে যায়। এ ধরনের বিরূপ অভিজ্ঞতা কাটানোর জন্য ই-ভিসার ব্যবস্থা দ্রুত করতে পারলে এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এতে অন্তত বিদেশি পর্যটকদের দুর্ভোগ কমে যাবে। বিদেশিরা এই ই-ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। ই-ভিসাটা জরুরি ভিত্তিতে চালু করে দিতে পারলে ভিসার সমস্যাটা দূর হবে বলে মনে করেন শিবলুল আযম কোরেশী।

বিদেশি পর্যটক এলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুরতে গিয়ে বিপাকে পড়েন পূর্ব অনুমতি নিতে গিয়ে। বিষয়টির ব্যাপারে টোয়াবের এই সাবেক নেতা বলেন, সমস্যা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোন পর্যটক যেতে চাইলে পূর্ব অনুমতি নিতে মাস খানেক সময় লেগে যায়। এ কারণে আমার দেশের এজেন্সিগুলো বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে কমিটমেন্ট রাখতে পারেন না। বিদেশি পর্যটক এলেও ওইসব এলাকায় অনুমতি না পাওয়ার কারণে তাদেরকে নিয়ে যেতে পারেন না। ফলে এটি অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিদেশি পর্যটকদের মনে। এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধান করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। 

তিনি এও মনে করেন, এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে বিদেশি পর্যটক আসা বাড়বে। তখন এক পর্যটকের মাধ্যমে আরেকজন পর্যটক বাংলাদেশ বেড়াতে আসবেন। ফলে এটি গাণিতিক এবং জ্যামিতিক হারে বাড়ানো সম্ভব। কেননা পর্যটনে আমাদের দেশে যথেষ্ট আকর্ষণ করার মতো স্থান রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: 

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, বিদেশি পর্যটক আসার ব্যাপারে আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি। সেটি হলো বিদেশি নাগরিকদের ভ্রমণের ব্যাপারে তাদের দেশের পক্ষ থেকে যে অ্যালার্ট দেয়া আছে সেটি তুলে নেওয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট মিশনগুলোকে জানিয়েছি। এই এলার্টগুলো যাতে তুলে নেওয়া হয়। এজন্য আমরা একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি সরকারের কাছে। সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে অ্যালার্ট তুলে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলবেন। সেই দেশগুলো যাতে বাংলাদেশের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়। তখন সেই দেশগুলো থেকে ট্যুরিস্টরা সহজে আসতে পারবেন। এছাড়াও আমরা মসজিদ, সুন্দরবন এবং বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে তিনটি বই বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাস ও হাই কমিশনগুলোতে পাঠিয়েছি এবং তারা বিভিন্ন অকেশনে বিদেশি ট্যুরিস্ট যাতে বাংলাদেশে আসে সেই ব্যবস্থা করবে। 

এছাড়াও তিনি জানান, শ্রীমঙ্গলে ২৬টি নৃ-জনগোষ্ঠী নিয়ে একটি হারমোনি ফেস্টিভ্যাল করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং সেটি তারা প্রতিবছর করতে চান। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ২৬ টি নৃ-জনগোষ্ঠীর ৬৫টি কালচারাল অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়েছে সেই আয়োজনে। সেগুলোর ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। এগুলো এখন এডিটিং পর্যায়ে। এই কাজ শেষ হলে সেই ভিডিওগুলো বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে পাঠানো হবে। যাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন পর্যটকরা এই কালচারাল অনুষ্ঠান দেখতে আসেন। এটা ব্যাপকভাবে প্রচার এবং ব্র্যান্ডিং করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ট্যুরিজম বোর্ড।

bb_1736581704

শুধু তাই নয়, গেল বছর রাজধানীর বনানী কামাল আতাতুর্ক পার্কে হয়ে যাওয়া ফুড ফেস্টিভ্যাল প্রতি বছর করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে খাবার প্রিয় মানুষজন এই ফুড ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে আসে। 

বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ট্যুরিজম বোর্ড যা যা করছে:

এদিকে ট্যুরিজম বোর্ড জানিয়েছে, গেল বছর দেশের পর্যটন খাতকে বহির্বিশ্বের পর্যটক প্রিয় মানুষদের কাছে তুলে ধরার জন্য চারজন জনপ্রিয় ইউটিউবারকে আনতে পেরেছেন তারা। এর মধ্যে দুজন চাইনিজ ভ্লগার, একজন সাউথ কোরিয়ান এবং একজন ইটালিয়ান। এই চার ইউটিউবার নিজ নিজ দেশে ফিরে বাংলাদেশের পর্যটন খাত নিয়ে ভিডিও বানিয়ে নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত করাতে ইতোমধ্যে লন্ডনে দুজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এজন্য তাদের কোনো ধরনের টাকা দিতে হবে না। কিন্তু তারা বাংলাদেশের হয়ে কাজ করবেন। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরা যাতে সহজেই ই-ভিসা পান বিষয়টি সহজ করতে কাজ করে যাচ্ছে পর্যটন বোর্ড। ইতিমধ্যে বিষয়টি সহজ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

এমআইকে/ইএ