images

অর্থনীতি

পুরনো স্বর্ণ বিক্রির সময় দাম কেটে রাখা হয় কেন?

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:১৭ এএম

বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য একটি খাত স্বর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত স্বর্ণ নিতান্ত প্রয়োজনের সময় অনেক কাজে লাগে। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা তৈরির ক্ষেত্রে অন্যান্য যেকোনো সম্পদের বিপরীতে স্বর্ণ একটি সেরা বিকল্প। অনেক দিন আগে কেনা স্বর্ণ বিক্রি বা বিনিময় করে নতুন স্বর্ণ কেনার সময় কিছু খরচ রয়েছে, যা স্বর্ণের দাম থেকে কেটে রাখা হয়।

কেটে নেওয়া অংশটি স্বর্ণ থেকে অর্জিত লাভে তেমন কোনো প্রভাব না ফেললেও বিষয়টি জেনে রাখা জরুরি। চলুন, স্বর্ণ সংক্রান্ত কোনো কোনো খাতের খরচগুলোর স্বর্ণের দামের সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করা হয় তা জেনে নেই।

বর্তমানে স্বর্ণের দাম থেকে কত শতাংশ কাটা হয়
২০২৪ সালের ৮ মে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) বিক্রির সময় স্বর্ণের দাম থেকে কর্তন বাবদ নতুন পরিমাণ নির্ধারণ করে। পুরনো স্বর্ণ বিক্রির সময় তার বর্তমান ওজন থেকে ১৫ শতাংশ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অংশের দামকে বিক্রয়মূল্য ধরা হবে। উদাহরণস্বরূপ ১০০ গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করতে গেলে তার দাম পাওয়ার যাবে ৮৫ গ্রামের জন্য।

যারা পুরনো স্বর্ণ দিয়ে নতুন স্বর্ণ নিতে চান তাদের ক্ষেত্রে আগের স্বর্ণের ওজন থেকে ১০ শতাংশ কেটে নতুন স্বর্ণ দেওয়া হবে। অর্থাৎ ১০০ গ্রাম পুরনো স্বর্ণের বদলে পাওয়া যাবে ৯০ গ্রাম স্বর্ণ।

এর সঙ্গে ধার্যকৃত যাবতীয় মজুরি এবং মূল্য সংযোজন করও (ভ্যাট) স্বর্ণের দাম থেকে বাদ যাবে।

আগে স্বর্ণ বিক্রির ক্ষেত্রে কর্তনের হার ছিল ১৩ শতাংশ, আর বিনিময়ের সময় কাটা হতো ৯ শতাংশ।

স্বর্ণের বিশুদ্ধতা যাচাই
স্বর্ণের অলঙ্কারে তামা বা রৌপ্যের মতো সংকর ধাতু মিশ্রিত থাকে। এই সংকর ধাতু মিশ্রিত থাকা মানেই স্বর্ণের সামগ্রিক বিশুদ্ধতায় ঘাটতি থাকা। পুনঃবিক্রয়ের সময় স্বর্ণের এই বিশুদ্ধতা বা গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য শিখা পরীক্ষা, অ্যাসিড পরীক্ষা ও এক্সআরএফ বা হলমার্কের মতো বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। উচ্চ বিশুদ্ধতা (২৪ ক্যারেট) সম্পন্ন স্বর্ণ কম বিশুদ্ধগুলোর (২২ ক্যারেট বা ১৮ ক্যারেট) তুলনায় অধিক মূল্যের হয়। বাজুস স্বচ্ছতা ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সেই বিশুদ্ধতা পরীক্ষা এবং সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করে থাকে।

অবচয় খরচ
যেকোনো ব্যবহার্য সম্পদের মতো স্বর্ণেরও অবচয় ঘটে। পুরনো স্বর্ণগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই স্ক্র্যাচ, আঘাতের চিহ্ন ও দীপ্তি হ্রাসসহ গুণগত মান নষ্টের আশঙ্কা থাকে। এতে অল্প হলেও ১০ বছর আগের ও পরের স্বর্ণের মধ্যে তারতম্য থেকে যায়। আর এই অপূর্ণতাকে সামঞ্জস্য করার জন্য কর্তনকৃত অংশ নির্ধারণ করা হয়। একদম সামান্য অংশ হলেও বিষয়টিতে বিক্রেতাদের সচেতন থাকা উচিত। অবশ্য পুনঃব্যবহারে অতিরিক্ত অবচয়ে স্বল্প ওজনের স্বর্ণের দামে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে।

লেনদেনের খরচ
স্বর্ণ বিক্রি শুধুমাত্র কিছু পরিমাণ ধাতু হস্তান্তর করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরো বিক্রয় প্রক্রিয়াটির সঙ্গে আরও কিছু কার্যক্রম জড়িত থাকে। যেমন বিক্রয় প্রক্রিয়াকরণে প্রশাসনিক ফি, পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা যাচাই ফি, স্বর্ণ মজুদ ও পরিবহনের নিরাপত্তা এবং লজিস্টিক খরচ ইত্যাদি। এই যাবতীয় খরচ একত্রিত হয়ে অবদান রাখে স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের অধোগতিতে। তাই এই খরচগুলোর ব্যাপারে বিক্রেতাদের সম্যক ধারণা থাকা জরুরি।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর খরচ ও ঝুঁকি
স্বর্ণের বাজারের ডিলার বা বিপণী মালিকদের ব্যবসা পরিচালনা বাবদ বিভিন্ন খরচ যুক্ত হয় এই তালিকায়। এগুলো হচ্ছে দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল। প্রত্যেকটির ব্যয়ভার বহনের সাপেক্ষে যাচাই করা হয় বাজারের বর্তমান অবস্থা। এই সার্বিক দিক বিবেচনায় খরচের পরিধি অনেকটা বেড়ে যায়। আর এই খরচটিই ক্রেতারা পুষিয়ের নেওয়ার চেষ্টা করেন বিক্রয়কালে ভোক্তাদের নিকট থেকে। এটি ডিলারদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কেননা এটি তাদের স্বর্ণ কেনা এবং ব্যবসার আনুষঙ্গিক খরচ থেকে উদ্বৃত্ত লাভের উপর প্রভাব ফেলে।

তাছাড়া পুরনো স্বর্ণ কেনার সময় ক্রেতারা স্বভাবতই একটু বেশি ঝুঁকির মুখে থাকেন। বিশেষ করে কেউ লেনদেনে জালিয়াতি করলে বা পণ্যের সত্যতা-সংক্রান্ত কাগজপত্রে ঘাটতি থাকলে পরবর্তীতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

স্বর্ণ বিক্রির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও আইনগত দিক
স্বর্ণ বিক্রি বা বিনিময়ের সময় লেনদেনগুলো অবশ্যই লিখিত হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে দরকারি নথিগুলো হচ্ছে লেনদেনের রশিদ, সত্যতার প্রশংসাপত্র এবং স্বর্ণের উৎপত্তি ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র। সঠিক নথিকরণ না হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই স্বর্ণের সত্যতা যাচাই করতে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে পারেন।

অধিকাংশ সময় এরকম অসাবধানতায় বিক্রেতারা কম দাম পান বা চূড়ান্ত লেনদেনে বিলম্ব হয়।

স্বচ্ছতা ও লেনদেনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিক্রেতার জন্ম নিবন্ধনপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে হবে। বিশেষ করে দেশের বাইরে থেকে স্বর্ণ এনে দেশের বাজারে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতাদের এই কাগজপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক। উপরন্তু চুরির মতো সম্ভাব্য সমস্যাগুলো প্রতিরোধের জন্য বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার্থে তাদের বর্তমান ঠিকানা ও ফোন নম্বরও সরবরাহ করা উচিত।

আমদানি বিধিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ শুল্কমুক্তভাবে বাংলাদেশে আনা যায়। সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের স্বর্ণের জন্য বাংলাদেশে আগতদের অবশ্যই কাস্টমসে জবাবদিহি করতে হবে ও প্রযোজ্য শুল্ক দিতে হবে। এ সময় বিক্রেতাদের অবশ্যই তাদের পাসপোর্ট, ভিসা, এনআইডি, কাস্টমসে স্বীকারক্তি ও ট্যাক্স পেমেন্ট সার্টিফিকেটের কপি প্রদর্শন করতে হবে। শুল্ক পরিশোধ ছাড়া এই পরিমাণ বা এর থেকে বেশি পরিমাণে স্বর্ণ আনা বেআইনি।

এই খাতগুলোতে হওয়া যাবতীয় খরচের সমুদয় অর্থ বিক্রির সময় স্বর্ণের দাম থেকে কেটে রাখা হয়। এর মধ্যে বিশাল অংশ থাকে স্বর্ণের প্রাথমিক বিশুদ্ধতা নিরীক্ষা ও লেনদেনের খরচের সঙ্গে অলঙ্কারের দোকান বা ক্রেতার ব্যবসায়িক সার্ভিস চার্জের মধ্যে।

এছাড়া ব্যবহারের ফলে অবচয় খরচ স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাজুকের প্রমিত কর্তন সামগ্রিকভাবে স্বর্ণকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক নীতিমালা ও বাজারের অবস্থাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখে। এরপরেও লেনদেনের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্রেতাকে নজর রাখতে হবে স্বর্ণ-সংক্রান্ত সঠিক কাগজপত্রের প্রতি। অন্যদিকে বিক্রেতাকেও সচেতন থাকতে হবে ক্রেতার দাবিকৃত খরচগুলোর ব্যাপারে।

এইউ