নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ মে ২০২৪, ০৪:৫৬ পিএম
বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, তারা মেরুদণ্ড সোজা রেখে সিদ্ধন্ত গ্রহণ করতে পারছে না। বাইরে থেকে আরোপিত সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শনিবার (১৮ মে) এফডিসিতে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য এমন পার্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, আইএমএফের পরামর্শক্রমে ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। তবে যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় একীভূতকরণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জোর করে ব্যাংক একীভূতকরণ টেকসই হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, সুশাসনের অভাবে সামগ্রিক অর্থনীতিকে সাপোর্ট দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকিং সেক্টর হারিয়েছে। জনগণ ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা হারিয়েছে। ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত নিরাপদ রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারছে না। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য জনগণ জানতে পারছে না।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ঋণ জালিয়াতি, ঋণ খেলাপি, অর্থ পাচার বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কালো দাগ। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ব্যক্তি বিশেষের আরাম আয়েশ, ভোগ—বিলাস দেশের অর্থনীতিতে ক্যান্সারের আকার ধারণ করেছে। আর্থিক খাতের এই ক্যান্সারের চিকিৎসা না করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল বা ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুফল পাওয়া যাবে কি না তা বুঝতে আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, তবে দেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না। নানা আইনি সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সুশাসন ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে। তাই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলমান সংকট উত্তরোণের যে প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই জরুরি। ঋণ জালিয়াতকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। রাষ্ট্রিয়ভাবে তাদের নাগরিক সুবিধা সীমিত করা উচিৎ। আমরা দেখি ঋণ খেলাপি ও অর্থ পাচারকারীরা এয়ারপোর্টে ভিআইপি হিসেবে যাতায়াত করছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কোনোভাবে চিহ্নিত আর্থিক দুষ্কৃতিকারী।
তিনি আরও বলেন, খাত আজ তছনছ হয়ে গেছে গেছে। বেসিক ব্যাংক লুট হয়েছে, পদ্মা ব্যাংক লুট হয়েছে, ইউনিয়ন ব্যাংকে ভল্ট কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা আছে। আর ন্যাশনাল তো জন্ম থেকেই জ্বলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় যে কয়টি ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল তার সবকয়টিই খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এসব ব্যাংকের মালিকদের শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট করা। এখন পদ্মার সাথে এক্সিম ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। এতে এক্সিম পদ্মায় ডুবে যায় কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আবার এক্সিম ব্যাংকেরই বা কি অবস্থা তা নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এছাড়াও তিনি বলেন, সম্প্রতি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। যার ব্যাখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া উচিৎ। আমাদের মনে রাখতে হবে সরকারের উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম। দেশের আর্থিক খাতের বড় বড় অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে সাংবাদিকরা। বাজেটকে সামনে রেখে আর্থিক খাতের নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিয়ে যে বাধা রয়েছে তা অচিরেই দূর করা উচিৎ। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ভল্টের স্বর্ণ খোয়া যাওয়া, ঋণ খেলাপি, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম গণমাধ্যমে তুলে ধরা তো সাংবাদিকদের অপরাধ নয়, বরং পেশাগত দায়িত্ব।
আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রেখে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে গ্রহকদের আস্থা ধরে রাখতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়:
১) ব্যাংক থেকে নামে বেনামে আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কার করে অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা।
২) আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা।
৩) ঋণ জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণ খেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের নামের তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা।
৪) আর্থিক খাতে জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তি ও ঋণ খেলাপিদের সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা সীমিতকরণ, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান এবং নতুন ঋণ না দেওয়াসহ দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করা।
৫) যারা ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করে লুটপাট করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।
৬) দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত গ্রহণ ও বিতরণ ছাড়া অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ করে এর ক্ষতির দায় কে নেবে তা স্পষ্ট করা।
৭) বাংলাদেশ ব্যাংকে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা নিরসন করা।
৮) রিজার্ভ চুরির জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে অর্থ প্রাপ্তির পরিমাণ ও অগ্রগতি সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত করা।
৯) ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করা।
১০) ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সুফল পেতে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা।
টিএই/এএস