ঢাকা মেইল ডেস্ক
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৮ পিএম
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামা ধরে নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পদের যে হিসাব প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় প্রার্থীদের মধ্যে যারা কোটিপতি তাদের ৮৭ শতাংশ আওয়ামী লীগের। তাদের সংখ্যা ২২৬ জন। আর ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এরকম প্রার্থী ১৮ জন।
মোট ১৫ জন মন্ত্রী ও এমপির আয় অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে। নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৬০ জন সংসদ সদস্যের আয় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কমেছে ৩৭ জনের। অপরিবর্তিত আছে ১০৭ জনের। অন্যদের আয় ৫০ শতাংশের কম হারে বেড়েছে। পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশের বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৬৭ জনের। অনেকেরই আয় বেড়েছে অকল্পনীয়ভাবে।
নির্বাচনের হলফনামায় মন্ত্রী-এমপিদের অকল্পনীয় সম্পদ বৃদ্ধি তদন্তের সুযোগ আছে। দুদক, এনবিআর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তদন্ত করে দেখতে পারে তারা বৈধ উপায়ে এই সম্পদ অর্জন করেছেন কি না।
অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, তারা যেহেতু সরকারের মন্ত্রী-এমপি তাই দুদক করছে না। আর দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আমাদের তথ্য দিলে আমরা তদন্ত করতে পারি। দুদক নিজেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করতে পারে। তবে এধরনের তদন্তের উদাহরণ তেমন নাই।’
আয় ও সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা
গত পাঁচ বছরে আয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের, হার দুই হাজার ২৩৮ শতাংশ (প্রায় চার কোটি ৮৮ লাখ)। ১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে রয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, হার ছয় হাজার ৩৫০ শতাংশ (প্রায় ১০ কোটি)। সবচেয়ে বেশি আয় বেড়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সীর। দুই হাজার ১৩১ শতাংশ। সম্পদের শীর্ষে আছেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
পাঁচ বছরে যেসব মন্ত্রী আয় বৃদ্ধিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। তার বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বেড়েছে ২২৮ শতাশ। ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের বেড়েছে ২২৭ শতাংশ। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বেড়েছে ২০৪ শতাংশ।
পাঁচ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে যারা আছেন তারা হলেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এক হাজার ৬৩ শতাংশ। এরপর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ২৪২ শতাংশ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর ২৪২ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ২৩৯ শতাংশ, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের ১৯৬ শতাংশ, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ১৭৩ শতাংশ, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের ১৪০ শতাংশ।
গত পাঁচ বছরে ১০ জন এমপির আয় অসম্ভব গতিতে বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদের আয় বেড়েছে দুই হাজার ২৩৮ শতাংশ, কুষ্টিয়া-১ আসনের সরওয়ার জাহানের দুই হাজার ২০০ শতাংশ, বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নার দুই হাজার ৭৪ শতাংশ, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইললাম বকুলের এক হাজার ৯৭২ শতাংশ, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিনের এক হাজার ৬০৮ শতাংশ, নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দীন তরফদারের এক হাজার ৪৯৪ শতাংশ, দিনাজপুর-৪ আসনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এক হাজার ১৮৭ শতাংশ, পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবিরের এক হাজার ৬০ শতাংশ এবং যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদের আয় এক হাজার ৩৯ শতাংশ বেড়েছে।
এক মন্ত্রীর যুক্তরাজ্যে ছয় কোম্পানি
টিআইবি জানিয়েছে, বর্তমান মন্ত্রিসভায় এমন একজন সদস্য রয়েছেন, যার যুক্তরাজ্যে ছয়টি কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ ১৭.২০ কোটি পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। তিনি সেখানে প্রথম কোম্পানি স্থাপন করেন ২০১০ সালে আর পঞ্চম ও ষষ্ঠ কোম্পানি ২০২১ সালে। ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সরকার চাইলে আমরা তার তথ্য প্রমাণ দেব। আমাদের কাছে তা আছে।’
আইন আছে আইন নাই
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো লাভজনক কাজে জড়িত থাকতে থাকতে পারেন না। এই যে মন্ত্রী এমপিদের হাজার হাজার শতাংশ সম্পদ বৃদ্ধি এটা বৈধ উৎস থেকে হয়েছে কি না তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। জনমনে এটা নিয়ে যৌক্তিক উদ্বেগ আছে। এখানে অনিয়ম, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার না হলে এই বিশাল পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধি সম্ভব নয়।’
‘আর যাদের দেশের বাইরে সম্পদ আছে তারা সেটা কীভাবে উপার্জন করেছেন? এখান থেকে পাচার করেছেন, না ওই দেশে আয় করেছেন তাও দেখা প্রয়োজন,’ মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
তার কথা, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ার আছে অস্বাভাবিক আয় তদন্ত করে দেখা। আর তারা যে সম্পদ ও আয়ের কথা বলছেন তার কর তারা দিয়েছেন কি না তাও দেখা দরকার। এটা এনবিআরের কাজ।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘অস্বাভাবিক আয় বৃদ্ধি যদি হলফনামায় পাওয়া যায় তা অনুসন্ধান করতে পারে দুদক। তবে মনে রাখতে হবে, আয় বৃদ্ধি কোনো অপরাধ নয়। তাই এটা যেন হয়রানির জন্য না হয়।’
আর দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যদি হলফনামা আমাদের কাছে পাঠায় আমরা অনুসন্ধান করে দেখতে পারি। আর আমরাও স্বাধীনভাবে করতে পারি। কিন্তু হলফনামা তো নির্বাচনের পর আর ওয়েবসাইটে থাকে না। হলফনামা ধরে দুদক তদন্ত করেছে এমন নজির তেমন নাই।’
প্রার্থীদের হলফনামা ভোটারদের জন্য। তারা যাতে সেটা দেখে কাকে ভোট দেবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর কেউ কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়েছে এমন অভিযোগ পেলে সেটা তদন্ত করে দেখে কমিশন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এর বাইরে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। অভিযোগের বাইরে কমিশন কিছু করতে পারে না। এটা এনবিআর, দুদক দেখতে পারে।’
মন্ত্রী-এমপি তো সম্পদ বাড়ানোর জন্য হয়
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানের ১৪৭(৩) অনুচ্ছেদ মতে মন্ত্রীরা কোনো লাভজনক কাজে থাকতে পারেন না। কিন্তু এখন রাজনীতি হয়ে গেছে অর্থ সম্পদ আয়ের উপায়। এজন্যই মন্ত্রী- এমপি হন। যারা মন্ত্রী-এমপি হন তারা অর্থ সম্পদ বৃদ্ধি করবেন এটাই এখন স্বাভাবিক।’
তার কথা, ‘দুদক আইনের ২৬ ও ২৭ ধারা দুদককে এইসব অস্বাভাবিক বা কোনো অবৈধ আয়ের তদন্তের ক্ষমতা দিয়েছে। তবে যারা এই সম্পদ অর্জন করেছেন তারা সরকারের লোক। সরকারি দলের নেতা। তাই দুদক স্বভাবতই তদন্ত করছে না।’ -ডয়চে ভেলে
জেবি