মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৯ পিএম
চলতি বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ‘অসাধু’ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। যা এখনও চলমান আছে। সরকারের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসেনি দ্রব্যমূল্য। বেশ কিছু জরুরি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও পাইকারি খোলাবাজার এমনকি সুপারশপেও প্রকাশ্যেই বাড়তি দামে বিক্রি হয় এসব পণ্য। নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এখনও সক্রিয় থাকে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। রীতিমতো পকেট কাটে ভোক্তাদের। গুটিকয়েক অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে যেন অসহায় কোটি ভোক্তা। অসাধু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেন মন্ত্রী আমলারাও। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা ছাড়া এই অসাধু সিন্ডিকেট টিকে থাকতে পারে না। সিন্ডিকেট যত শক্তিশালিই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
দফায় দফা দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর জরুরি তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা আর ডিমের পিস সর্বোচ্চ ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কমেনি এসব পণ্যের দাম। সারা বছর বাড়তি দামেই বিক্রি হয় জরুরি এসব পণ্য। উল্টো কয়েক গুণ বাড়ে পেঁয়াজের দাম।ওই সময় আলু বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত। যা এখন আলুর মৌসুমের সময়ও ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকায়। ডিমের দাম প্রতি পিস ১২ টাকা বা প্রতি ডজন ১৪৪ নির্ধারণ করা হলেও খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হয়। দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরপরই সুপারশপগুলোতে আলু পেঁয়াজ না থাকার খবর পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকার সুপারশপে পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামেই।
আরও পড়তে পারেন
সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কাগজে আছে, বাস্তবে নেই
আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে হিমাগারগুলোতে যে আলু ছিল তা অধিকাংশই ব্যবসায়ীদের। ফেব্রুয়ারি মার্চের দিকে চাষীরা জমি থেকে বিক্রি করেন ১০-১৫ টাকা কেজি। যা প্রতি কেজি উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ পড়ে ৮-৯ টাকা। কৃষক শুধু বীজের জন্য সামান্য আলু হিমাগারে রাখেন। গত মার্চে ব্যবসায়ীরা ৫০ কেজির বস্তায় ভরে আলু হিমাগারে রাখেন। বস্তা খরচ, হিমাগার ভাড়া, শ্রমিকসহ পরিবহন খরচ সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের খরচ হয় ২২-২৩ টাকার মতো। সেই আলু পাইকারিতে বিক্রি করে ৩৫-৪৫ টাকা পর্যন্ত। ওই সময় বেশ কয়েক জায়গায় হিমাগারে অভিযান চালিয়ে ৩৭-৩৮ টাকায় আলু বিক্রি করার সময় হাতেনাতে ধরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। করা হয় জরিমানা। প্রতি বছরই চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয় পেঁয়াজের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ বছর দেশীয় উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। তারপরেও অনিয়ন্ত্রিত ছিল পেঁয়াজের বাজার। বর্তমানে মৌসুমের সময়ও প্রতি কেজি নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়।
এছাড়াও সারা বছরেই চলে চিনি নিয়ে ছিনিমিনি। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে প্রতিকেজি পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও প্রতিকেজি পরিশোধিত খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩০ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৫০ টাকা।
এদিকে চলতি বছরে সাতবার বেড়েছে রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। এর মধ্যে কমেছে পাঁচবার। সর্বশেষ টানা পাঁচবার বেড়েছে জরুরি এই পণ্যটির দাম। বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৬৫ টাকা কমিয়ে এক হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যার আগের দাম ছিল এক হাজার ২৯৭ টাকা। পরবর্তী সময়ে ফেব্রুয়ারি মাসে এক ধাক্কায় ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মার্চ মাসে ৭৬ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৪২২ টাকা। এপ্রিল মাসে আবারও ২৪৪ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ১৭৮ টাকা। পরবর্তী সময়ে মে মাসে বাড়ে দাম। ওই মাসে ৫৭ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর জুন মাসে আবারও দাম কমে এলপিজির। ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৫৯ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৭৪ টাকা। জুলাই মাসে হাজার টাকার নিচে নামে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম। ৭৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৯৯৯ টাকা। পরে টানা পাঁচ মাস ধরে বাড়তে থাকে এলপিজির দাম। আগস্ট মাসে ১৪১ টাকা বাড়িয়ে ১১৪০, সেপ্টেম্বরে ১৪৪ বাড়িয়ে ১২৮৪, অক্টোবরে ৭৯ টাকা বাড়িয়ে ১৩৬৩, নভেম্বরে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৮১ ও ডিসেম্বর মাসে ২৩ টাকা বাড়িয়ে ১৪০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
আরও পড়তে পারেন
বছরজুড়ে ‘সাতে-পাঁচে’ এলপি গ্যাস
নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করেন খোদ মন্ত্রী আমলারাও। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘গত বছর দাম কম পাওয়ায় এ বছর আলুর উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। তাছাড়া আমরা কিছু আলু রফতানি করেছি। তারপরও আলুর দাম এতটা বেশি হওয়া উচিত নয়। এটা হয়েছে সিন্ডিকেটের কারণে। আমরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
আরও পড়তে পারেন
ডজনের দামেও মিলছে না এক হালি
এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘আলু ও পটলের দাম নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে ঠিক করা হয় না। এটা আমাদের দেশেই হয়। আমাদের লজ্জা লাগে, যখন কালোবাজারিরা বলে, দাম নিয়ে আমরা কী করব? সরকার তাদের কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। জনগণের যদি অংশগ্রহণ না থাকে, সমাজের যদি সহযোগিতা না থাকে, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষে একা সম্ভব হবে না। কালোবাজারিরা পাগলা ঘোড়ার মতো চলতেই থাকবে। তাদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ কাজ করে না।’
সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তোপের মুখে পড়তে হয় বাণিজ্যমন্ত্রীকেও।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা সমালোচনাসহ বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসে বিশেষজ্ঞরা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। আপনার যদি জ্বর হয়। চিকিৎসক আপনাকে হয়তো প্যারাসিটামল দিলো। এতে আপনার জ্বর হয়তো সাময়িকভাবে কমতে পারে। কিন্তু জ্বরতো বড় কোনো রোগের উপসর্গ। এখন যদি মূল রোগের টিটমেন্ট না দিয়ে শুধুমাত্র জ্বরের চিকিৎসা করা হয় তবে এমন অবস্থা হওয়াটা স্বাভাবিক। এখন যে কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে মূল জায়গায় ধরা হচ্ছে না। আমাদের দেশে তো যথেষ্ঠ উৎপাদন হয়। সিন্ডিকেট চাঁদাবাজির কারণে কারণে যে দাম বাড়ছে সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সেসব জায়গায় হাত না দিয়ে যদি একটা দাম বেধে দেন তাহলে তো আর সমস্য সমাধান হবে না। সরকার বা সরকারি দলের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে আমাদের মতো সরকার ব্যবস্থায় কোনো ধরনের অন্যায় হতে পারে না।’
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার তো সব কিছু বিবেচনা করে হিসাব নিকাশ করেই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে স্বাভাবিক মুনাফা হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তো স্বাভাবিক লাভে আগ্রহী না। বেশি লাভ করতে চায়। এখন ব্যবসায়ীদের এই প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তবে যেখানে থেকে উৎপাদন হয় অথবা যেখান থেকে পণ্য ছাড় হয় সেখানে মূল্যটা প্রথম ঠিক করতে হবে। সাপ্লাই চেইন যদি ঠিক রাখা যায়, তবে পাইকারে খুচরা পর্যায়ে একটু তত্ত্বাবধায়ন করলেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। কড়াভাবে বলছে, শুধু বললেই হবে না। কড়াভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
টিএই/এএস