images

অর্থনীতি

জ্বলছে না চুলা, ধুঁকছে শিল্প কারখানা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১০ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৩ এএম

পুরোপুরি শীত আসার আগেই প্রকট আকার ধারন করেছে গ্যাস সংকট। রাজধানীর অনেক এলাকায় দিনের বেলা জ্বলছে না চুলা। গ্যাস সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে অনেক শিল্প কারখানার উৎপাদন। অনেক আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে দুপুর তিনটা পর্যন্ত একেবারেই গ্যাস পাচ্ছেন না মানুষ। তিনটার পরেও গ্যাস আসলে তা একেবারেই সীমিত। কিছু এলাকায় সকাল ৭টায় গিয়ে একেবারে রাত ১০টায় গ্যাস আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে নাকাল জীবন যাপন করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

রাজধানীর মুগদা, মান্ডা, মানিক নগর, বাসাবো, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, কামরাঙ্গিচর এলাকায় গ্যাস সংকট যেন নিয়মিত সমস্যা। এছাড়াও শীতকালে গ্যাস সংকট বেশি দেখা দিত। কিন্তু সম্প্রতি রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাতেই গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক ভোগান্তিতে রয়েছেন নগরের সব শ্রেণির মানুষ। এসব এলাকার অধিকাংশ ভুক্তভোগীর ভাষ্য সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩-৪টা পর্যন্ত ঠিকমতো গ্যাস থাকছে না। রাতে রান্না করে রাখার পরে সকালে দিনের বেলা যে তা গরম করব সেই উপায়ও থাকছে না অনেক এলাকায়। এতে অনেকেই ইলেক্ট্রিক চুলা ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন।

রাজধানীর উত্তর মুগদা কমিশনারের গলি এলাকার রোজিনা জানান, কয়েক দিন ধরে গ্যাস একেবারেই থাকছে না। ভোরে একটু আসে। ৭টার দিকে চলে যায় আর সারাদিন আসে না। একেবারে আসে রাত ১০টা-১১টার দিকে। সারাদিনে যে একটা ডিম ভাজি করব সেই গ্যাসও থাকে না। একেবারে চুলা জ্বলে না।

একই এলাকার এক বাড়িওয়ালা বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই সকালে গ্যাস চলে যাচ্ছে। আসছে একেবারে রাতে। আমরা বাড়িওয়লারা মিলে কয়েক দিন ধরে তিতাস অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছি, কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

2

আবার তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তিতাস গ্যাসের মতিঝিল জোনের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মনজুর আজিজ মোহন ঢাকা মেইলকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ কম থাকলেও একেবারে থাকে না এই ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। যদি কোনো এলাকায় এই ধরনের সমস্যা হয় তবে আমাদেরকে জানালে আমরা সমস্যা সমাধান করব।

গ্যাস সংকট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ইসমাইল হোসাইন শাহিন নামে একজন ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ফেসবুকে লেখেন, আমি যাত্রাবাড়ী-কোনাপাড়া এলাকাতে থাকি। বিগত অনেক বছর ধরে সকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। রাত ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা গ্যাস দিয়ে কি ছিড়বে জনগণ। মাস শেষে ১০৮০/- ফাও বিল দিচ্ছি। পাশাপাশি সিলিন্ডার ও ইলেক্ট্রিক চুলার বিলও দিচ্ছি। আমি কিছু দেশে দেখেছি কোনো লাইনের গ্যাস নাই। সব সিলিন্ডার গ্যাস। গ্যাস না দিলে এই লাইনের গ্যাস কেন রাখা হচ্ছে? জনগণের সাথে এই সব প্রতারণা বাদ দিয়ে হয় লাইনের গ্যাস দিন, প্রয়োজনে মিটার সিস্টেম করুন। আর সবচেয়ে উত্তম হয় লাইন গ্যাস চিরতরে বাদ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ সিলিন্ডার এর আওতায় নিয়ে আসুন। শুধু সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ১০০০ টাকার মধ্যে রাখুন।

এদিকে শুধু আবাসিকই নয়। তীব্র গ্যাস সংকট রয়েছে শিল্প খাতেও। বন্ধ রাখতে হচ্ছে শিফট। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। সঠিক সময় উৎপাদন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রফতানি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা মেইলকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। রাতের বেলা গ্যাসের চাপ থাকলেও দিনের বেলায় প্রেশার একদম পাওয়া যায় না। ফলে উৎপাদন অনেক ব্যহত হচ্ছে। সময়মতো আমরা প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে পারছি না। শিপমেন্ট ব্যাহত হয়ে সরবরাহ করা মাল স্টক লটে পরিণত হচ্ছে। অনেক বায়ারকে সময়মতো প্রোডাক্ট দিতে না পারায় তারা অর্ডার ক্যানসেল করছে। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

3

পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দেশে গ্যাসের চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে সব সময়ই ব্যাপক ফারাক থাকে। দেশে স্বাভাবিক গ্যাসের যে চাহিদা, তাতে অন্তত চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। এখন বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি, দেশের গ্যাস সব মিলিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট। ডিসেম্বর মাসে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমতে পারে। এত দিন সাড়ে ৮শ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে নেটওয়ার্কে সরবরাহ করা হতো। এছাড়া সার কারখানা বন্ধ ছিল। ফলে প্রাপ্ত গ্যাসের প্রায় পুরোটাই শিল্পকারখানায় সরবরাহ করা হতো। এখন সার কারখানা চালু হওয়ায় সেখানে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে এলএনজি টার্মিনালে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে ৬শ মিলিয়ন ঘটফুট। তাই গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস অনুসন্ধান না করে আমদানি নির্ভরতার কারণে গ্যাস সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা আমদানির দিকেই বেশি ঝুঁকছে। এজন্য এই ধরনের সংকট হবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও গ্যাস চুরি অবৈধ সংযোগের কারণে সংকট আরও বাড়ছে। যতদিন এই সমস্যাগুলো সমাধান না হবে ততো সংকট থাকবেই।

টিএই/এএস