images

অর্থনীতি

চ্যালেঞ্জের মুখে এনবিআর

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:২৮ এএম

আইএমফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধে চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেশি আয়কর আদায়ের প্রতিশ্রুতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না। এনবিআর কখনোই তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো কর প্রশাসনের অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং অটোমেশনের অভাব।

গত অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন লাখ ২৫ হাজার ২৭২ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ের তিন খাতের মধ্যে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এ খাতে এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। একই সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক আদায়ে ঘাটতি ১৬ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এ খাতে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর ও ভ্রমণ কর আদায়ে ঘাটতি নয় হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের রিজার্ভ-সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করছে আইএমএফ

২০২১-২২ অর্থবছরের মোট রাজস্ব আদায়ের তুলনায় গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ৮.১২ শতাংশ হলেও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে এনবিআর পিছিয়ে আছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে তিন লাখ ৮৫২.৪১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। ঘাটতি ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকার। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি তার চেয়েও ১৬ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

আইএমএফ জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের অনুপাত ৭.৮ থেকে বাড়িয়ে ৯.৫ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে। আইএমএফের প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে এনবিআর আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে বাড়তি এই কর আদায়ে এনবিআর চলতি অর্ববছরে আদায় করতে পারলেও তা টার্গেটের চেয়ে কম হবে। বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারাই বলেছেন, কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হলো চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে

২৪ হাজার কোটি টাকার নয় হাজার কোটি টাকা বেশি আসবে নতুন আয়কর থেকে আর বিভিন্ন মামলায় আটকে থাকা কর থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে বলে এনবিআর মনে করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয়কর থেকে আদায় হয়েছিল এক লাখ ১২ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে আয়কর বাবদ মোট আদায় হবে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না। এনবিআর কখনোই তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো কর প্রশাসনের অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং অটোমেশনের অভাব।

২০১৮ সালে সিপিডি এক জরিপে দেখেছে, বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছে। কিন্তু তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

এখানে মোট রাজস্বের ৩৫ ভাগ আসে আয়কর বা ডাইরেক্ট ট্যাক্স থেকে। আর বাকি ৬৫ ভাগ আসে ভ্যাটসহ অন্যান্য ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স থেকে। এটা একটি বড় দুর্বলতা। আয়কর থেকে সবচেয়ে বেশি আদায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘২৪ হাজার কোটি টাকা গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি কর আদায় করলে তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ শতকরা ১০ ভাগ বেশি কর আদায় হবে। তাতেও তো চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। এনবিআর কখনোই তার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এই কর প্রশাসন দিয়ে তা সম্ভব হবে বলে মনে করি না।’

Taka

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা, দুর্নীতি আর অটোমেশনের অভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানে কর ব্যবস্থা এখনো চলে কাগজে-কলমে। কোনো আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। আয়কর দিতে সক্ষম একটি গোষ্ঠীকে করের আওতায় তারা আনতে পারছে না। আবার উচ্চ আয় এবং করপোরেট আয়ের বড় একটি অংশ কর ফাঁকি দেয়। তাদের ধরা হয় না। এনবিআরের লোকজন তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে ছাড় দেয়। অথচ যারা সৎ করদাতা তারা হয়রানির শিকার হন।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘করব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়ের চিত্র তাদের কাছে পরিষ্কার থাকতো। ব্যাংকিং সিস্টেমকে আরও আধুনিক করলে কর ফাঁকি দেওয়া কঠিন হতো। সেটা করা হচ্ছে না। আইমএফের চাপ কেন, আমরা যদি রাজস্ব আয় না বাড়াতে পারি, তাহলে অর্থনীতিই তো চাপের মুখে পড়বে। তবে যেসব সংস্কার প্রয়োজন তা অল্প সময় বা এক বছরে সম্ভব নয়।’

আরও পড়ুন: জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৬ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংকের

আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ বাড়ানোর র্শত দিয়েছে। পরের দুই অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ০.৫ শতাংশ ও ০.৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে। এই তিনটি অর্থবছরে কর-জডিপিরি অনুপাত ১.৭ শতাংশ বাড়াতে হলে এনবিআরকে অতরিক্তি দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২৪ হাজার কোটি টাকা গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি কর আদায় করলে তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না। এতে বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ শতকরা ১০ ভাগ বেশি কর আদায় হবে। তাতেও তো চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। এনবিআর কখনোই তার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। 

সিপিডির ডিস্টিংগুইশ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাজস্বের মূল সোর্স হতে হবে ডাইরেক্ট ট্যাক্স (আয় কর)। কিন্তু আমাদের এখানে উল্টো। দুই ভাগের তিন ভাগ আসে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স থেকে। ডাইরেক্ট ট্যাক্সের অনেক লুপ হোল এবং অনেক সম্ভাবনার জায়গা আছে। সেগুলো দেখতে হবে। আর সেটা দেখে কর আদায় বাড়াতে হলে কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে হবে।’

তার কথা, ‘এখানে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সবার আগে দরকার ডিজিটাইশেন। দ্বিতীয়ত, এক্সপোর্ট এবং ইমপোর্টে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও কাস্টমসের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন আরও বাড়াতে হবে। সেটা হলে ব্যত্যয় বিচ্যুতি ধরা সহজ হবে।’

‘চতুর্থত, এনবিআরের জনশক্তিকে আরো দক্ষ করতে হবে, লোকবল বাড়াতে হবে। ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশনের দিকে জোর দিতে হবে। পঞ্চমত, সবকিছু এনবিআরের ওপর নির্ভর করে না। এখানে স্ট্রং রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার আছে। যেসব বিচ্যুতি, ব্যত্যয় হয় তার প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’ সূত্র: ডয়চে ভেলে

জেবি