images

অর্থনীতি

ডিমের বাজারে প্রতিদিন ১৭ কোটি টাকার কারসাজি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৯ পিএম

দুই সপ্তাহ আগে মুরগির একটি ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা৷ এখন তা ১৫ টাকা৷ দাম বাড়ার কেনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা ব্যবসায়ীদের কাছে নেই৷ তারপরও দাম বাড়ছে৷

১৫ দিন আগের দামের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতিদিন সারাদেশের ক্রেতাদের কাছ থেকে সব মিলিয়ে বাড়তি নেওয়া হচ্ছে ১৭ থেকে ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা৷

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, দেশে প্রতিদিন সবধরনের ডিমের মোট চাহিদা চার কোটি ৫০ লাখ পিস৷ আর উৎপাদন আছে পাঁচ কোটির মতো৷ তিনি বলেন, ‘দেশে ডিমের উৎপাদন হঠাৎ করে কমে যায়নি৷  তবে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে৷ তারপরও খুচরা পর্যায়ে একটি ডিম এখন কোনোভাবেই ১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়৷ আসলে ডিমের বাজার খামারিদের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ এটা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান৷ তারাই ঠিক করে দেয় ডিমের দাম৷’

তিনি জানান, প্রতিদিন সকালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন ডিমের দাম ঠিক করে দেয়৷ আর সেই দামেই সারাদেশে ডিম বিক্রি হয়৷ এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই৷ তারা তাদের নির্দিষ্ট এজেন্টদের মাধ্যমে সকাল ১০টার মধ্যে মোবাইল ফোনের এসএমসএস, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সারাদেশে ডিমের দাম জানিয়ে দেয়৷ সেই দামেই বিক্রি হয়৷ এর সঙ্গে উৎপাদন বা চাহিদার তেমন সম্পর্ক থাকে না৷

কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘গত বছর একইভাবে ডিমের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ তারপরও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দামে কিছুটা পার্থক্য ছিল৷ কিন্তু এবার এমনভাবে সিন্ডিকেট করা হয়েছে যে গ্রাম পর্যন্ত খুচরা দাম একই৷’

EE2

গত বছরের আগস্টে একইভাবে ডিমের বাজারে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়৷ তখন ভোক্তা অধিদফতর অভিযান চালিয়ে ও তদন্ত করে কাজী ফার্মসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ পায়৷ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়৷ ওই পর্যন্তই৷ এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সেই মামলায় কোনো ফল হয়নি৷ তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি৷ তাই তারা মজা পেয়ে গেছে৷ আবারো সিন্ডিকেট করে মুনাফা লুটছে৷’

বাংলাদেশে এখন পোল্ট্রি খামারি আছে ৬০ হাজার৷ তাদের মধ্যে ২০ হাজার খামারি ডিম উৎপাদন করেন ৷ আর ৪০ হাজার খামারি মুরগি উৎপাদন করেন৷ এই ৬০ হাজার খামারের মধ্যে ১৯ হাজার খামারিকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-এর আওতায় নিয়ে গেছে  কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান৷ এটা দাদন ব্যবসার মতো৷ তাদের আগাম টাকা দিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেওয়া হয়৷ সারা বছর সেই একই দামে ডিম ও মুরগি কেনে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান৷ দেশে মোট খামারের তিন ভাগের একভাগ তারা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে৷ বাকিরা বিচ্ছিন্ন৷ তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ তাদের আবার নিজস্ব ফার্মও আছে৷

সাভারের খামারি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই সময়ে ডিমের চাহিদা একটু বেশি থাকে৷ কিন্তু ডিম উৎপাদন কমেনি৷ পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে৷ আসলে এখন দাম আমাদের হাতে নেই৷ আর বাজারে যে ডিমের এত দাম তা কিন্তু খামারিরা পায় না৷ আমাদের একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকা৷ ৪০-৫০ পয়সা বেশি দামে আমরা বিক্রি করতে পারি৷ লাভের টাকা চলে যায় করপোরেটদের হাতে৷’

সুমন হওয়ালাদার অভিযোগ করেন, ‘কাজী ফার্মস ও প্যারাগন গ্রুপ এখন ডিমের বাজারে মূল খেলোয়াড়৷ দেশে  পোল্ট্রি শিল্প নিয়ে তিনটি সমিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে ৷ তারাই এগুলো গঠন করেছেন বাজার তাদের দখলে রাখার জন্য৷’

ভোক্তা অধিদফতর ছাড়াও গত বছর আগস্টে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, ডায়মন্ড এগ, পিপলস ফিডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন৷ কমিশন ওই মামলার শুনানিতে প্রতিদিন সকালে কাজী ফার্মস যেভাবে ডিমের দাম ঠিক করে দেয় তাতে বিস্ময় প্রকাশ করে৷

ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা গত বছরের আগস্টে ডিমের বাজার অস্থির হওয়ার পর পুরো বিষয়টি তদন্ত করেছি৷ আমরা দেখেছি বাজারে সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে৷ আমরা অভিযান চালিয়ে মামলা করেছি, জরিমানা করেছি৷ আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদন জমা দিয়েছি৷ আমাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা কমিশন কাজী ফার্মসহ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে৷ কিন্তু তারপরও আবার সিন্ডিকেট সক্রিয়৷’

EE3

তার কথা, ‘আমরা আবার অভিযান শুরু করেছি৷ কিন্তু সমস্যা হলো, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত তা তো আমাদের ‘আনুষ্ঠানিকভাবে' জানা নেই৷ এটা বলতে পারবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ৷ তারা যদি আমাদের জানায় একটি ডিমের উৎপাদন খরচ কত, তাহলে আমরা বাজারে কত বিক্রি হচ্ছে তা দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি৷’

তা না হলে অভিযান চালিয়ে লাভ হয় না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা৷ তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে কারওয়ান বাজারের অভিযান চালিয়ে এক ব্যবসায়ীকে ২০ হজার টাকা জরিমানা করেছি৷ ফল হয়েছে - অন্যান্য ডিমের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে৷ তারাও তো কিনে আনে৷ আমরার জানা দরকার উৎপাদন খরচ কত৷ তাহলে খুচরা বিক্রয়মূল্য কত হওয়া যৌক্তিক তা আমরা বুঝতে পারব৷’

সুমন হাওলাদার বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটা বড় দায়িত্ব আছে৷ তারা ডিম, মুরগির উৎপাদন খরচ কত সে ব্যাপারে যদি তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যেতে৷ আর পোল্ট্রি ফিডের দাম কমিয়েও ডিম ও মুরগির দাম কমানো সম্ভব৷’

জানা গেছে, এ নিয়ে রোববার (১৩ আগস্ট) মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে৷

ডিম সিন্ডিকেটের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, সেই কাজী ফার্মস-এর কোনো বক্তব্য চেষ্টা করেও জানা যায়নি৷ -ডয়চে ভেলে

জেবি