কান্ট্রি ডেস্ক
১২ জুন ২০২৩, ১১:৫১ এএম
চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি বলেছিলেন, ‘যদি কারোর কাছে যেতে হয় তবে যাও প্রকৃতির কাছে, তিনি হোন তোমার ঈশ্বরী।’ ভিঞ্চির এ আপ্তবাক্যকে তিনি তার আঁকা চিত্রে প্রতিফলিত করেন। তারই চেনা পরিপার্শ্বের এই ভূচ্ছবি তিনি এঁকে দেখালেন। এইসব দৃশ্য অবধারিতভাবে যেন ওপরের আকাশের সঙ্গে কথা বলে। কারণ এ ছবি, এ বৃক্ষ বিরল। এটাই এই অঞ্চলের বিশেষত্ব।
বিনয়ী, চিন্তাশীল ও গম্ভীর এ শিল্পীর নাম রেজাউল করিম-আর করিম নামে সবাই চেনে তাকে। করিমের বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালী পৌরসভায়। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পড়াশোনা করছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স তৃতীয় বর্ষে।
যে শিল্পী যত বাকপটু তার কদর ততই বেশি। করিম তার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। কথা বলেন কম। পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীর জলতরঙ্গে তার অবস্থান ছায়াসম, নিস্তব্ধ; অথচ নিত্যবিদ্যমান—শিল্পের প্রতি তার এরকম আত্মমগ্নতা তাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি ছবি আঁকছেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় চার হাজারের বেশি ছবি এঁকেছেন। প্রকৃতি আর মানুষের মুখ আঁকতে তিনি পছন্দ করেন। বেশির ভাগ কাজই হচ্ছে জলরঙে আঁকা। গুঁটি কয়েক পেনসিল, বলপেন ছাড়াও লতা-পাতা, কাঠ-কয়লা, বালু, মসুরের ডাল দিয়ে মানুষের মুখ তৈরি করেন।
তার সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক বলেন, ‘আর করিম এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি যেকোনো বস্তুকে শিল্পে উত্তরিত করে তুলতে পারেন।’ পেনসিলে আঁকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; যেটি কবি করিমের অনুমতি নিয়ে ‘কবিতাকুঞ্জ’ বইয়ে ব্যবহার করেছেন।

কোথাও বালু—কোথাও একটুকু টলটলে পানি মিলিয়ে রচিত দৃশ্যের মধ্যে যে এত রঙ আছে, সাদৃশ্যের সঙ্গে অ্যাবস্ট্রাকশনের যে আভাস আছে, সেটা ধরে করিম বলছেন তার প্রকৃতির কথা, প্রকৃতির সঙ্গে তার বেড়ে ওঠার কথা। প্রকৃতির পরিবর্তনই এ শিল্পীর কাছে অর্জন বলে মনে হয়। দিন দিন নতুন কিছু শেখা, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়াই করিমের কাছে পরিবর্তন। এ শেখাই অর্জন বলে মনে করেন তিনি। করিমের কাছে ছবি এঁকে অর্থ উপার্জন করা অর্জন নয়। মানুষের ভালোবাসাই তার বড় অর্জন। এ অর্জনই তিনি ধরে রাখতে চান। তার অর্জনগুলো দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিরতিহীন এঁকে চলেছেন।
নেশা থেকে ছবি আঁকাকে পেশা বানিয়েছেন তিনি। আঁকা ছাড়া কোনো কিছু বোঝেন না। তিনি মনে করেন, এখন তাকে দিয়ে ছবি আঁকা ছাড়া আর কোনো কাজ হবে না। প্রথম যখন ছবি আঁকতে শুরু করেন; তখন নিজের আগ্রহ বোঝার মতো বয়সও হয়নি। বয়স তখন ছিল মাত্র তিন। প্রকৃতির কাছ থেকে তিনি ছবির অনুপ্রেরণা খোঁজেন। পাঠ্য বইয়ের ছবি তার আঁকার উৎস। ছবি আঁকার বইটি তাকে খুব আকর্ষণ করত। সেই থেকে চেষ্টা ও পরিশ্রম করেই যাচ্ছেন এই তরুণ শিল্পী। যদিও ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই তার। তিনি স্বশিক্ষিত বলেই তার ছবিতে সিলেবাসের দায়মুক্ত এক ধরনের স্ফূর্তি আছে।
যে পরিসর শিল্পীর স্বাচ্ছন্দ্য, যে উপকরণে প্রেরণা আসে শিল্পীর কর্মে-মননে; যে শিল্পীর (যেকোনো মাধ্যমে) সৃষ্ট শিল্পকর্মে ও মননে সবচেয়ে বেশি—সেই সব সাজিয়ে তিনি নিজেকে হাজির করেন, আত্মপ্রকাশ করেন। ভাবনা ও গঠনে মুনশিয়ানা আছে তার, নির্মাণে নেই বাহুল্যের অকারণ প্রয়াস। আবার করিম কোথাও কোথাও ঈষৎ রেখার বুনট ব্যবহার করেছেন।
করিমের আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জয়নুল আবেদীন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন ফরিদী, আনোয়ারা সৈয়দ হক, হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, আইয়ুব বাচ্চু, আনিসুল হক. শিমুল মুস্তফা, উল্লেখযোগ্য। তার দাবি, আজ পর্যন্ত তিনি সুরসম্রাট মান্না দে’র যত ছবি এঁকেছেন তা আর কেউ আঁকেননি। তার প্রায় শতাধিক ছবি এঁকেছেন এ তরুণ চিত্রশিল্পী।

মহেশখালীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ফুটেছে তার রঙ-তুলিতে। জেলেদের বিপন্ন জীবনধারা, মাঝি-মাল্লাদের জীবিকার সংগ্রাম, গ্রামীণ জনপদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনাচরণ তার হাতে শৈল্পিক ছোঁয়া পেয়ে একেক চিত্রকর্ম হয়ে উঠেছে। জয়নুল আবেদীন কিংবা এস এম সুলতানের মতো শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে।
আর করিম এসেছিলেন ঢাকা মেইলের কান্ট্রি ডেস্কে। ঢাকা মেইলের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার তাকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় চার নেতা, বরেণ্য রাজনীতিবিদ, খ্যাতিমান শিল্পী-ব্যক্তিদের মুখাবয়ব যেন তোমার রঙতুলিতে উঠে আসে। তোমার ছবি নিশ্চয় নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের কথা বলে।
ভবিষ্যতে করিমকে তার আঁকা চিত্র প্রদর্শনী করার জন্য তাগিদ দেন। এ প্রদর্শনীতে ঢাকা মেইল তার পাশে থাকবে বলে তিনি জানান।
আর করিম বলেন, ‘আঁকার মধ্যে ভুল নেই, দেখার মধ্যে ভুল...আপনি ভালো করে দেখেননি বলেই তো আঁকতে পারেন না।’ কথাগুলো হৃদয়স্পর্শী, কিন্তু গভীরতা অনেক। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটাই—ছবি এঁকে যাওয়া।
/এইচই/