images

সারাদেশ

২০০ বছরের পুরোনো লিচু গ্রাম ‘মঙ্গলবাড়িয়া’

জেলা প্রতিনিধি

২০ মে ২০২৩, ০৪:৪৩ পিএম

সুস্বাদু, রসালো ও সুন্দর ঘ্রাণের কারণে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ্যাতি দেশজুড়ে। গ্রামের নামেই নামকরণ হয়েছে এ লিচুর। ঠিক কত বছর আগে এবং কীভাবে এখানে লিচু চাষের প্রচলন শুরু হয়েছে, তা জানা না গেলেও প্রবীণদের ধারণা, অন্তত দুইশ বছর আগে এখানে লিচু চাষ শুরু হয়।

প্রথমে শৌখিনতার পর্যায়ে থাকলেও গত কয়েক দশক ধরে এ গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় লিচু চাষ। মাঙ্গলবাড়িয়ার সাফল্য দেখে পাশের নারান্দি, কুমারপুর, হোসেন্দি ও শ্রীরামদি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে লিচুর চাষাবাদ।

লিচুচাষ করে নিজেদের ভাগ্যবদল করেছে গ্রামবাসী। এবার লিচুর বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি তারা। এখন চলছে লিচু সংগ্রহ ও বিপননের কাজ। সবমিলিয়ে এ মৌসুমে আট থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে ধারণা করছে কৃষিবিভাগ।

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে সারি সারি ঝুলে থাকা লাল টকটকে লিচু। এ যেন লিচুর রাজ্য। যেদিকে চোখ যায় লিচু আর লিচু। লিচুর ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ। গোলাপরাঙা পাকা লিচুর ভারে নুয়ে পড়েছে অনেক গাছ। ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে তুলে খাওয়া যায়।

kishorgonj

লিচু কেনা ও বাগানে ঘুরে বেড়াতে দূর-দূরান্তের লোকজনও ছুটে আসছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ গাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন পছন্দের লিচু। সব মিলিয়ে এই গ্রামে এখন যেন এক মনোরম ও উৎসবমুখর পরিবেশ।

পার্শবর্তী উপজেলা কটিয়াদিতে বসবাস করলেও মিম আক্তার এবারেই প্রথম এসেছেন মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু বাগানে। জেনেছেন ফেইসবুকের কল্যাণে। তাইতো প্রথমবার হাতের নাগালে এত লিচু পেয়ে উচ্চশিত তিনি। খাওয়ার পাশাপাশি নিয়েছেন পরিবারের জন্যও।

রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসের একটি করপোরেট অফিস থেকে সব সহকর্মীরা মিলে এসেছেন মঙ্গলবাড়িয়ায়। তারা জানান, এই লিচুর নামডাক এখন দেশজুড়ে, সে জন্য তারা এসেছেন অফিসের সবার জন্য লিচু নিতে। এসে তারা আশাহত হননি। লিচুর স্বাধ ও ঘ্রাণ তাদের মুগ্ধ করেছে।

দম ফেলারও সময় নেই লিচুচাষি ও পাইকারদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লিচু সংগ্রহ ও বিক্রির কাজে ব্যস্ত সবাই। স্থানীয়রা বলছে, লিচুর হাত ধরেই তাদের জীবনে এসেছে সচ্ছলতা। লিচু বাগানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়া ও আশপাশের এলাকায় আট থেকে দশ হাজার ফলবতী লিচুগাছ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। এ খাত থেকে লাভবান হচ্ছে পাইকাররাও। তারা মৌসুমের শুরুতে এক বছরের জন্য কিনে নেয় কৃষকের অনেক গাছ। পরে বেশি দামে বিক্রি করে গাছের উৎপাদিত ফল।

kishorgonj

দীর্ঘদিন ধরে লিচু চাষ করছেন এলাকার তৌহিদ মিয়া, তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এককানি ক্ষেতে আমারা ৪০মন ধান পাইতাম, কিন্তু লিচু চাষে খরচ বাদেই আশি হাজার টাকা লাভ পাচ্ছি। তাই এখন গ্রামের সবাই লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা হৃদয় মিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় দিচ্ছেন লিচু চাষে। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিয়েছে এই লিচু। আমাদের এসব লিচু বিক্রি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। ক্রেতা ও পাইকাররা ভালো দাম দিয়ে বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যায়।

শতবছর বয়সী মিরাজ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের বাপ-দাদাদের দেখছিলাম ছোটবেলায়। নিজেরা খাওনের লাগি লাগাইছিন। এহন দেখতে দেখতে চোক্কের সামনে এই গেরামের ব্যাবসায় পরিণত হইছে।

মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু আকারে যেমন বড়, তেমনি রঙ, স্বাদ ও গন্ধেও ব্যতিক্রমি গুণের অধিকারী। যে কারণে সারাদেশে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর রয়েছে বাড়তি কদর ও চাহিদা। তাই মৌসুমে স্থানীয় বাজারে এগুলো খুব একটা দেখা যায় না। লোকজন গ্রামে গিয়ে সরাসরি কিনে নিয়ে যায় তাদের পছন্দের লিচু। এবার লিচুর ফলন হয়েছে ভালো, তবে দামও বেশি। একশ লিচু বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আটশ টাকায়।

Kishorgonj

আশির্ধ্ব বয়সী লিচুর পায়কার রমিজ মিয়া বলেন, আমাদের বাপদাদারাও এই ব্যাবসা করত। সংগ্রামের আগে থাইকতাই (১৯৭১ এর আগে) যখন আমরা লিচু ভাংত্ম করাচি থাইক্কা খবর হইত যে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু আসছে।

তিনি এই লিচু নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা মেইলকে আরও বলেন, এই লিচুর সঙ্গে স্বাদ ও ঘ্রাণ বাংলার আর কোনো লিচুর সঙ্গে মিলবে না।

লিচু সংগ্রহ করতে আসা আরেক পাইকার কাজল বলেন, সে এখানে ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে লিচু বাগান ক্রয় করে আসছে। কিছু লিচু স্থানীয় বাজারে নিয়ে বিক্রি করলেও বেশিরভাগ লিচু বাগান থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। যার মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ রয়েছে বিদেশি ক্রেতাও।

স্থানীয় আরেক পাইকার তওহিদ বলেন, এবার তিন লাখ টাকার লিচু কিনেছি যা ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভের মুখ দেখাবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর ই আলম মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু নিয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, এ বছর লিচু বিক্রি করে কৃষকরা আট থেকে দশ কোটি টাকা আয় করবে। স্বল্প খরচে অধিক মুনাফা পাওয়ায় অন্যান্য ফসলের ক্ষেতও এখন কৃষকরা রুপান্তরিত করছেন লিচু বাগানে।

লিচু চাষিরা বলছেন, সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃষি বিভাগের আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচুর আবাদ আরও বাড়ানও সম্ভব। লিচুর পরিকল্পিত চাষাবাদ পাল্টে দিতে পারে স্থানীয় অর্থনীতির চিত্র।

প্রতিনিধি/এসএস