জেলা প্রতিনিধি
২২ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:১০ পিএম
নওগাঁর একমাত্র মসজিদ যেখানে সব ধর্মের মানুষ ঘুরতে যেতে পারেন। কালো ও ধূসর রঙের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া প্রায় সাড়ে ৪শ বছরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্য ও স্মৃতিধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ‘কুসুম্বা মসজিদ। বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত আছে এর ছবি।
মসজিদটির অসাধারণ কারুকার্য খচিত মনোমুগ্ধকর কুসুম্বা মসজিদের অন্দর যে কাউকে আকর্ষণ করবে। বছরজুড়ে ভিড় থাকে পর্যটকদের। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখভাল করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
রাজশাহী বিভাগের উত্তরেই নওগাঁ জেলার অবস্থান। এটি বিভাগের বরেন্দ্রীয় অংশ। ভারত সীমারেখা ঘেঁষে থাকা নওগাঁ জেলার মোট উপজেলার সংখ্যা ১১টি। এর মধ্যে মান্দা অন্যতম। কারণ প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ও স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ‘কুসুম্বা মসজিদ’।
বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত আছে এর ছবি। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মান্দা ব্রিজের পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার উত্তরে ঐতিহাসিক এই মসজিদের অবস্থান। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি দেখার জন্য।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে এর আরেক নাম কালাপাহাড়। কুসুম্বা মসজিদকে তাই নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন বলা হয়। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি। দিঘিটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী ও মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ দিঘিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাড়েই তৈরি করা হয়েছে কুসুম্বা মসজিদ। কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৪২ ফুট।
চারদিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরু। তার ওপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে মোট ছয়টি গম্বুজ। যা দুইটি সারিতে তৈরি।
কুসুম্বা মসজিদ দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে ছোট। ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনানা গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর। এখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন।
মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকাজ করা। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নতমানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুইটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা ছিল। মসজিদের সম্মুখ ভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশপথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির এক খÐ কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।
কুসুম্বা মসজিদ সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপি এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশপথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০ সালে) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৫৮ বছর। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।
মসজিদে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী আলামিন ইসলাম বলেন, পাঁচ টাকার নোটে ছবি দেখে অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে বেড়াতে আসার। চারপাশের পরিবেশ অনেক সুন্দর। এখানে এসে ঘুরতে পেরে ভালো লাগছে।
খোরশেদ আলম, সৈকত হোসেনসহ আরও কয়েকজন দর্শনার্থী বলেন, এখানে ঘুরতে এসে সত্যি খুবই ভালো লাগছে, তবে যদি এখানে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করা হয় তবে এখানে ঘুরতে আসা দূর দূরান্তের দর্শনার্থীদের জন্য সুবিধা হতো।
আফজাল হোসেন নামের অপর এক দর্শনার্থী বলেন, বিপুল সম্ভবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে নওগাঁর এই ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষনীয় স্পট হিসাবে গড়ে উঠছে না।
১৫ বছর ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ইমাম আলী মসজিদের মূল খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও কুসুম্বা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল হোসেন আর শুক্রবার জুমার নামাজের ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তফা আলী।
ওবায়দুল হোসেন ও মোস্তফা আলী বলেন, মসজিদের ভেতরে চারটি কাতারে প্রায় ৮০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া মসজিদের সামনের অংশে খোলা স্থানে প্রায় ৭০০ মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার ও বছরে দুই ঈদের জামাতে মসজিদের ভেতর ও বাইরের পুরো চত্বর মুসল্লিতে ভরে যায়। এ ছাড়া পবিত্র রমজানে তারাবিহর নামাজও পড়া হয় এখানে। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন কুসুম্বা মসজিদ ঘুরে দেখতে। তবে শুক্রবার জুমার সময় বেশি মুসল্লির আগমন ঘটে।
এ বিষয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, কুসম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য অযু ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শনার্থীদের আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এরইমধ্যে পিকনিক স্পট ও বিশ্রামাগার নির্মাণ হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিনিধি/এইচই