images

সারাদেশ

বগুড়ার সাদা চিকন সেমাইয়ে দুরাশা

জেলা প্রতিনিধি

১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৩ এএম

বগুড়ার দইয়ের মতোই সেরা চিকন সেমাই। দেশজুড়ে আছে এর খ্যাতি। রং সাদা হলেও স্বপ্নটা রঙিন। এক সময় এটি ছিল গরিব মানুষের ঈদ আয়োজন। আর এখন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত—সব মানুষের ঘরে ঈদ আয়োজনের সঙ্গী। আর ঈদের খাবারের মেন্যুতে অবশ্যই থাকা চাই সেমাই। এ কারণে ঈদ এলেই বেড়ে যায় বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর।

তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও জ্বালানি তেলের সংকটে এখন কোনো কারখানাই পুরোদমে চালাতে পারছে না মালিকরা। এরমধ্যেই বাজারে বেড়েছে চিনি ও ময়দার দাম। যার প্রভাব পড়েছে বগুড়ার সেমাইপল্লীতে। ফলে বিগত দিনের তুলনায় উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন উদ্যোক্তারা। সেমাই উৎপাদনে অর্ধশত কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ৪০০ নারী শ্রমিক কাজ করলেও এবার এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। 

bogura
 
পবিত্র রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে অলস সময় পার করছেন বগুড়ার সেমাইপল্লীর কারিগররা। সারা বছরই কমবেশি সেমাই উৎপন্ন হয় এই গ্রামগুলোতে। ঈদের চাহিদা বিবেচনা করে সাদা চিকন সেমাই তৈরি করলেও বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

স্বাধীনতার পর থেকেই বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের বেজোড়া গ্রামের কয়েকটি পরিবার চিকন সাদা সেমাই তৈরি শুরু করে থাকেন। বেজোড়া ছাড়াও উপজেলার কালিসামাটি, শ্যাওলাগাতি, শ্যামবাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামেও এ ধরনের সেমাই তৈরি হয়। 

কলসিমাটি এলাকার সেমাইকল মালিক নুর আলম বলেন, ২০ বছর যাবত আমি এই চিকন সেমাই তৈরি করে আসছি। গত বছরেও ভালো বেচাকেনা করেছি। এবছর ভালো বেচাকেনা করতে পারছি না। তিনি বলেন, ময়দা, চিনির দাম দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে। গত বছর ২৫০ বস্তা ময়দা থেকে সেমাই তৈরি করেছি, কিন্তু এই বছর মাত্র ২৩ বস্তা থেকে সাদা সেমাই তৈরি করছি। দাম বাড়ার কারণে শ্রমিকদের মজুরি দিতে না পেরে এখন নয়জন থেকে কমে তিনজন শ্রমিক কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, আগে ২৫ কেজির এক খাঁচি সেমাই এক হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো। সব পণ্যের দাম বাড়ায় ৬০০ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করছি। এছাড়া কর্পোরেট হাউসগুলোও এখন সাদা চিকন সেমাই তৈরি করছে। তাই আমাদের সেমাই কম বিক্রি হচ্ছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান এই চিকন সেমাই নিয়ে গিয়ে ঘি অথবা তেল দিয়ে ভেজে প্যাকেটজাত করে বেশি দামে বাজারে ছাড়ছে। এতে করে আমাদের সেমাইয়ের কদর কমে গেছে।

bogura

শিরিন খাতুন নামের এক সেমাই কারখানার মালিক বলেন, ‘ভেবেছিলাম করোনার লোকসান কাটিয়ে এ বছর লাভের মুখ দেখব। কিন্তু যেভাবে চিনি ও ময়দার দাম বেড়েছে, তাতে আমাদের এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে উঠেছে।’

শাজাহানপুর উপজেলার বেজোড়া গ্রামের সেমাই কারখানার মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর রমজান মাস এলেই সেমাই তৈরি কার্যক্রম শুরু হয়। মেশিন চলে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ব্যস্ততা অনেক কমেছে। আশা করছি তাও লাভ হবে। 

শব-ই বরাতের পর থেকেই শুরু হয়েছে সেমাইয়ের উৎপাদন। প্রতিদিন ভোর থেকেই কারখানাগুলোয় শুরু হয় সেমাই তৈরির কাজ। চলে আসরের নামাজ পর্যন্ত। সেমাইকল মালিকরা জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ ময়দার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

bogura

সেমাই কারখানার নারী শ্রমিক শেফালী খাতুন বলেন, ‘ঈদের আগে এই সময় আমাদের দম ফেলার সময় থাকত না। কিন্তু এ বছর আমাদের হাতে কোনো কাজ নেই। কারণ, কারখানা মালিকরা লোকসানের শঙ্কায় মেশিন বন্ধ রেখেছেন। এদিকে আমরা আগের চেয়ে কম মজুরি নিয়ে কাজ ধরে রেখেছি।’

আরেক নারী শ্রমিক আছিয়া বেগম বলেন,শব-ই-বরাতের পর থেকেই সেমাই তৈরি শুরু হয়ে যেত, কিন্তু এ বছর খুব কম সেমাই তৈরি করা হচ্ছে। গত ২০ বছরেও এ রকম অবস্থা দেখিনি। শ্রমিকের মজুরি-বিদ্যুতের খরচ, সব বাদ দিয়ে খাঁচি প্রতি খুব সামান্যই থাকে। 

সেমাইয়ের দাম না বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশের এখন নামি-দামি অনেক কোম্পানিই সেমাই তৈরি করছে। তাদের যাঁতাকলে আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমরা লাভ করতে পারছি না। 

তিনি জানান, আগে গ্রামের প্রায় ১০ থেকে ১৫টি পরিবার সেমাই তৈরির কাজ করত। এবার গ্রামের মাত্র ৫টি পরিবার সেমাই তৈরি করছেন। এখন অনেকেই কল বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনিই তৈরি করছেন।

শ্যাওলাগাঁতি এলাকার সেমাই কল মালিক শেকুল ইসলাম বলেন, আমি জন্ম প্রতিবন্ধী, ১০ বছর যাবত সেমাই তৈরি করে আসছি। এনজিও থেকে লোন নিয়ে এবার সেমাই তৈরি করতে শুরু করে হিমসিম খাচ্ছি। ময়দা ও চিনির দাম বেশি। গত বছর ৩৭ কেজির প্রতি বস্তা ময়দা ১২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনলেও এবার সেই ময়দা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত।

bogura

এক বস্তা ময়দা থেকে প্রায় ৩৫ কেজি সেমাই উৎপাদন হয়। আগে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করা হত। এখন কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। ময়দার দাম বৃদ্ধির তুলনায় সেমাইয়ের দাম খুব একটা বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলেও তিনি জানান।

বগুড়া শহরের রাজাবাজার এলাকায় সেমাইয়ের বাজার ঘুরে দেখা যায়, রমজানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে বেচাকেনা। রাজা বাজারে চিকন সেমাই বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ৮০ থেকে ৯০ টাকা আর খুচরা ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি।

এ বিষয়ে রাজাবাজার আড়তদার ও সাধারণ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, গত বছরের মতো এবার সাদা সেমাইয়ের মার্কেট নেই। মূলত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির কারণে বগুড়ার সাদা চিকন সেমাই বিক্রি কমেছে।

প্রতিনিধি/এইচই