জেলা প্রতিনিধি
১০ এপ্রিল ২০২৩, ০২:১২ এএম
‘আমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা-মা বৃদ্ধ তারাও আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারে না। ছেলে-মেয়ের সামনে কাঁদলে তারাও কাঁদে। মেঝো ছেলেটা আমার কান্না দেখে তার বাবার কবরে গিয়ে কাঁদে। এগুলো সহ্য করতে পারি না। ছোট মেয়েটি বলে মা তুমি কেঁদো না, আমাদেরও কান্না পায়। ছোট ছেলেটি আমার চোখের পানি মুছে দেয়। এখন আর তাদের সামনে কাঁদি না। গভীর রাতে গোপনে আল্লাহর কাছে কাঁদি।’
রোববার (০৯ এপ্রিল) বিকেলে স্বামীর মৃত্যুর পর ৫ সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন কাটানো রেহানার বাড়িতে গেলে এভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি মনের দুঃখ প্রকাশ করেন।
এদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে রেহানার বিষয়টি লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দকে অবহিত করলে তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, ওই নারীর পক্ষ থেকে একটি লিখিত আবেদন করলে দ্রুত আর্থিক সহয়তা করা হবে।
জানা গেছে, রেহানার বয়স ৩৫ বছর। বর্তমানে তার ৫ সন্তান নিয়ে সংসার জীবন। প্রায় আড়াই বছর আগে তার স্বামী দিনমজুর ইব্রাহিম হোসেন স্ট্রোকজনিত কারণে মারা যান। এরপর থেকেই দুঃখ-দুর্দশায় সন্তানদের নিয়ে দিন কাটছে তার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি বিধবা ভাতা দিলেও অন্য কোনো ধরণের সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে না তাকে।
রেহানা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আটিয়াতলি গ্রামের মনছুর আলী হাওলাদার বাড়ির বাসিন্দা। বিধবা রেহানা এখন বড় ছেলে আহাম্মদ আলী রাহাদ (১৮), মেঝো ছেলে মো. ফাহিম (১৩), ছোট মেয়ে লামিয়া আক্তার (১০) ও ছোট ছেলে সফিক উল্যা রাব্বিকে (৪) নিয়ে অভাবে সংগ্রাম করে দিন পার করছেন। বড় মেয়ে খাদিজা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা আর মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনরকম সংসার চালাচ্ছেন রেহানা। কিছু টাকা যোগাড় করতে পারলেই সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে ইসলাম মার্কেট এলাকায় ওএমএসের চাল কিনে। এরপর হেঁটেই চাল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। রোববার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গণে যান টিসিবি পণ্য কেনার জন্য। কিন্তু তার কার্ড নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে প্রায় ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও সুবিধা করতে না পেরে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে।
রেহানার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১৫ দিন আগে পাশের একজনের বাসা থেকে কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে পড়ে গিয়ে রেহানার কোলে থাকা শিশু রাব্বির ডান পায়ের হাঁড় ভেঙে যায়। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ঘরে এসে ছেলের পা ভাঙার বিষয়ে নিশ্চিত হন তিনি। ঘটনার পর থেকে ৩ বার রাব্বিকে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। অভাবী সংসারে ছেলেটির চিকিৎসায় ধার-দেনা করে ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। এরপর আর খরচ করার সাধ্য নেই। ২১ দিনের মাথায় ফের ডাক্তার দেখানোর কথা রয়েছে। টাকার অভাবে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে রেহানার কপালে।
ছোট মেয়ে লামিয়া স্থানীয় আটিয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী। ফুটফুটে এ মেয়েটিও সুস্থ নয়। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকে। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি ছিল।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথার কারণে লামিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে এখন সে ছোট, অপারেশন করা ভালো লক্ষণ হবে না। এজন্য ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অভাবী মায়ের কাছে ওষুধ খরচ চালানো সম্ভব হয় না। ব্যথা উঠলে মেয়েটির কান্না সহ্য করতে না পেরে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় কয়েকদিন ওষুধ খাওয়ানোর পর আবার বন্ধ হয়ে যায়।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ছেলে রাহাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেটি এখন বিভিন্ন জনের জন্য কাজ করে অভাবী সংসারে যোগান দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজ নিয়মিত না থাকায় উপার্জনও তেমন নেই। সম্প্রতি গাছ কাটতে গিয়ে কুড়ালের আঘাতে জখম হয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটু সুস্থ হয়ে সে স্থানীয় জকসিন বাজারে কাঁচা তরকারি দোকানে কাজ শুরু করে। মেঝো ছেলে ফাহিম এবার স্থানীয় বাঙ্গাখাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণিতে উঠলেও অভাবের তাড়নায় বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সে এখন স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে ইলেক্ট্রিকের কাজ শিখছে।
মেঝো ছেলে মো. ফাহিম বলেন, বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূরে। হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব নয়। ঘরে মাঝে মাঝে ভাত রান্না হয় না। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য রিকশাভাড়া আমার মায়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিদ্যালয়ে যাচ্ছি না, এখন ইলেকট্রিকের কাজ শিখছি।
রেহানা বেগম বলেন, সবাই ইফতারের সময় ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে। কিন্তু আমার ঘরে ভাত রান্না করতেও কষ্ট হয়। ছেলেমেয়েরা যখন বলে- মা ইফতারে কি খাবো, তখন বুক ফেটে কান্না আসে। অসুস্থ ছেলে-মেয়ের ওষুধ খরচ চালাতে পারি না। কয়েকদিন পর ছোট ছেলেকে আবার ডাক্তার দেখাতে হবে। সেই টাকাও নেই। আর কতদিন মানুষ আমাকে সহায়তা করবে। কিভাবে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাঁচব। এক আল্লাহ ছাড়া এখন আর আমার কেউ নেই। এজন্য গভীর রাতে আল্লাহর কাছেই কাঁদি।
রেহানা প্রতিবেশী খালা তাজকেরা বেগম বলেন, রেহানার স্বামী দিনমজুর ছিলেন। অকালেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। ঘরভিটা ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পদ নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে রেহানা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় সে সহায়তাও করা সম্ভব হয় না।
লাহারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আবদুস সাত্তারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
লাহারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুস শহিদ বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। স্থানীয় ইউপি সদস্যকে বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিতে বলা হবে। খোঁজ নিয়ে রেহানা বেগমকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
প্রতিনিধি/এএস